ভেগার স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে বসে আছে মুসা। রাস্তার অন্য পাশে গাড়ি রেখেছে। অলিংগারের গাড়িটাকে ওরকম করে ছুটে যেতে দেখে বলল, নিশ্চয় আমাদের মেসেজ পেয়েছে।
এবং বিশ্বাস করে বসেছে, হাসতে হাসতে বলল কিশোর।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে মুসাও রওনা হলো। বেশ খানিকটা দূরে থেকে অনুসরণ করে চলল পোরশিকে। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় বেশি। ফলে চেষ্টা করেও গতি তুলতে পারছেন না অলিংগার। লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের সীমা ছাড়িয়ে আসার আগে। আর পারলেনও না।
পেছনে পড়ল শহরের ভিড়। তীব্র গতিতে ছুটছেন এখন অলিংগার। মুসাও পাল্লা দিয়ে চলেছে। পথের দুপাশে এখন সমতল অঞ্চল, বেশির ভাগই চষা খেত। কিছুদূর চলার পর মোড় নিয়ে মহাসড়ক থেকে একটা কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়ল পোরশি। ধুলো উড়িয়ে ছুটল আঁকাবাকা রুক্ষ পাহাড়ী পথ ধরে। ঢুকে যেতে লাগল পর্বতের ভেতরে। সামনে ছড়িয়ে রয়েছে পাইন আর রেডউডের জঙ্গল।
এই পথে পিছু নিলেই চোখে পড়ে যেতে হবে। গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো মুসা। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে তিন ঘন্টার পথ চলে এসেছে। এতদূর এসে শেষে বিফল হয়ে ফিরে যেতে হবে? অসম্ভব। প্রয়োজন হলে গাড়ি রেখে হেঁটে যাবে, তা-ও ফেরত যাবে না।
তা-ই করল ওরা। পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে রইল গাড়িতে, পোরশিটাকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিল। তারপর নেমে পড়ল। জোর কদমে ছুটল। হাঁটাও নয়, দৌড়ানও নয়, এমনি একটা গতি। ডবল মার্চ বলা যেতে পারে।
পথের প্রথম বাকটার কাছে একটা কাঠের কেবিন চোখে পড়ল। চিমনি থেকে কালো ধোয়ার সরু একটা রেখা উঠে যাচ্ছে পরিষ্কার আকাশে। ওখানেই ঢুকেছে নিশ্চয়? কি করছে ওটার ভেতরে দুজনে, ভাবল মুসা। ডিলন কি বলে ফেলেছে সে অলিংগারকে ফোন করেনি?
ভেতরে আগুন জ্বলছে, ভালই, মুসা বলল। যা শীত। আগুন পোয়াতে ইচ্ছে করছে আমার। দুই হাত ডলতে শুরু করল সে। পর্বতের ভেতরে ঠাণ্ডা খুব বেশি। আর শুধু টি-শার্ট পরে এসেছে ওরা। শীত লাগবেই।
পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকব? রবিন জিজ্ঞেস করল।
না, কিশোর বলল, সামনে দিয়ে ঢুকেই চমকে দেব।
সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে গেল তিনজনে। তারপর রেডি-ওয়ান-টু-থ্রী করে একসঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে পড়ল পাল্লায়। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলে ভেতরে ঢুকল। প্রথমেই ডিলনকে দেখার আশা করেছে।
কিন্তু ডিলনকে দেখল না।
বড় একটা ঘর। আসবাবপত্রে সাজানো। কেবিনটা যে কাঠে তৈরি সেই একই কাঠে তৈরি হয়েছে ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, কাউচ, বুককেস। জগিং করে শীত তাড়ানর চেষ্টা করতে দেখা গেল অলিংগারকে। উদ্বিগ্ন, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত চেহারা, পরাজিত দৃষ্টি সব দূর হয়ে গিয়ে অন্য রকম লাগছে এখন তাকে। তিন গোয়েন্দাকে দেখে খুশিই হলেন।
আরি, তোমরা? এখানে কি? ঘড়ি অ্যালার্ম দিতেই জগিং থামিয়ে দিলেন। তিনি। কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন একটা তোয়ালে দিয়ে। ঘাড়েও ঘাম। কপাল মোছা শেষ করে ঘাড়ে চেপে ধরলেন তোয়ালে।
জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না তিন গোয়েন্দা। তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে গিয়ে ডিলনকে খুঁজতে শুরু করল। ডিলন যে নেই সেটা জানতে বেশিক্ষণ লাগল না।
এখানে কি? প্রশ্নটা আবার করলেন অলিংগার। তিন গোয়েন্দাকে দেখে চমকাননি, যেন জানতেন ওরা আসবে। আমাকেই ফলো করছ, সন্দেহ হয়েছিল। এখন দেখি ঠিকই।
পাহাড়ে বেড়াতে এসেছি আমরা, ভোঁতা গলায় মুসা বলল।
সাপ খুঁজতে! শীতল কঠিন দৃষ্টিতে অলিংগারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
ডোনাট খাবে? হাসি হাসি গলায় জিজ্ঞেস করলেন অলিংগার।
ডোনাট? অবাক হয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কিশোর, হচ্ছেটা কি?
শ্রাগ করল কিশোর। বিমল হাসি হাসলেন অলিংগার। আগের চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিক হয়ে উঠেছে আচরণ। খেলে খেতে পার। অতিরিক্ত ফ্যাট। সে জন্যে আমার খেতে ভয় লাগে। তবু মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে পারি না। মেহমান আসবে বুঝতে পেরেছি। তাই বেশি করেই নিয়ে এসেছি। কমিশারি থেকে। আর ঠিক এসে গেলে তোমরা। চমৎকার কোইনসিডেন্স, তাই না?
কেবিনটা কার? জানতে চাইল কিশোর।
সঙ্কেত দিতে লাগল অলিংগারের ঘড়ি। আবার জগিং শুরু করলেন তিনি। আমার। এখানে এসেই শরীরের ব্যাটারি রিচার্জ করি আমি।
একা?
মোটেও না।
দম বন্ধ করে ফেলল মুসা। দ্রুত তাকাল এদিক ওদিক।
প্রকৃতির কোলে এসে কখনও একা হবে না তুমি, বললেন অলিংগার। তাজা। বাতাস। সুন্দর সুন্দর গাছ। বুনো জানোয়ার। সব সময় ঘিরে থাকবে তোমাকে। এত বেশি, ছত্রিশ ঘন্টার বেশি সহ্যই করতে পারি না আমি। আবার পালাই শহরে।
ঘড়ির সঙ্কেতের সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার জগিং থামালেন তিনি। মুখের ঘাম মুছে ভোয়ালেটা সরিয়ে আনার পর মনে হল তোয়ালে দিয়ে ঘষেই মুখের চওড়া হাসিটা ফুটিয়েছেন। তোমাদেরকে কিন্তু খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না। ব্যাপারটা কি?
আজ আপনার অ্যানসারিং মেশিনে একটা মেসেজ পেয়েছেন, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। আপনি ভেবেছেন, বেন ডিলন আপনার সাহায্য চেয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। সে জন্যেই এখানে এসেছেন আপনি। আপনি জানেন, ডিলন এখানেই লুকিয়ে আছে।
ডিলন এখানে? হা হা করে হাসলেন অলিংগার। চমৎকার। দারুণ। দেখো। তাহলে। বের করতে পার কিনা। যাও, দেখো।
এত আত্মবিশ্বাস কেন? মনে মনে অবাক হলেও চেহারায় সেটা ফুটতে দিল কিশোর। মেঝে, আসবাব, সব কিছুতে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। মাথা চুলকাতে লাগল সে।