চিৎকার করে উঠল মুসা। নাআআ! নিজের কানেই বেখাপ্পা, অপার্থিব শোনাল চিৎকারটী।
যত ব্যথাই করুক, কেয়ার করল না আর সে। জোরে জোরে গালমুখ ডলে আর মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথার ভেতরটা পরিষ্কারের চেষ্টা করল। হাতে লেগে থাকা কাদা মুখে লেগে গেল। ভেজা মাটির গন্ধ।
ওপর থেকে মাটি পড়া থেমে গেল।
হাঁটুতে ভর দিয়ে সোজা হল মুসা। উঠে দাঁড়ানর চেষ্টা করতে লাগল। কবরের ভেজা দেয়াল ধরে ধরে উঠল অবশেষে। চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, কিশোর, ওঠ! এই কিশোর, উঠে পড়ো! কিশোর.আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে…
নড়ে উঠল কিশোর। তাকে উঠতে সাহায্য করল মুসা। শার্টের বুক খামচে ধরে টেনে টেনে তুলল।
হয়েছে…হয়েছে…, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। কোথায়…কি… কথা বলার শক্তি নেই যেন। দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধ ঝাড়া দিয়ে মাটি ফেলার চেষ্টা করছে শরীর থেকে।
কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে এর পরের জরুরি কাজটায় মন দিল মুসা। কবরের দেয়ালে হাতের আঙুল আর জুতোর ডগা ঢুকিয়ে দিয়ে বেয়ে ওঠার চেষ্টা চালাল। খুব একটা কঠিন কাজ না। মাথায় যন্ত্রণা না থাকলে এটা কোন ব্যাপারই ছিল না। তবে এখন যথেষ্ট কষ্ট হলো।
বাইরে বেরিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না। নির্জন গোরস্থান। ঝিঁঝির একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে আগের মতই। ও হ্যাঁ, আরেকটা ডাকো, কুকুরটা ডাকতে আরম্ভ করেছে আবার।
কবরের পাড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা। প্রায় টেনে তুলল কিশোরকে। হাঁপাতে লাগল দুজনেই। মাথার ভেতরটা ঘোলাটে হয়ে আছে।
জলদি এসো, মুসা বলল, ব্যাটাকে ধরতে হবে। নিশ্চয় পালাতে পারেনি এখনও।
না, শার্ট থেকে মাটি সরাতে সরাতে বলল কিশোর, আড়ালে থেকে নজর রাখব আমরা। তাতে ওকে অনুসরণ করা যেতে পারে। পিছু নিয়ে দেখতে পারব কোথায় যায়।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল আবার দুজনে। একটা ক্যামারো গাড়িকে ছুটে যেতে দেখল হেডলাইট জ্বেলে, লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে। মিনিট খানেক পরেই। ভেগাটা চালিয়ে মুসাও রওনা হয়ে গেল। পাশে বসেছে কিশোর। ছোট গাড়িটাকে যতটা সম্ভব দ্রুত ছোটানোর চেষ্টা করল মুসা, কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চায় না ক্যামারোটাকে।
হান্টিংটন বীচ, লং বীচ পেরিয়ে এসে লস অ্যাঞ্জেলেসে ঢুকল গাড়ি। বেভারলি হিলের দিকে এগোল।
এলাকাটা পরিচিত লাগল মুসার কাছে। বলল, কয়েক ঘণ্টা আগেও না। এখানে ছিলাম?
স্ট্রীট লাইটের আলোয় পলকের জন্যে ক্যামারোর ড্রাইভারকে দেখতে পেল সে। বয়েস খুব কম মনে হলো, বড় জোর উনিশ, সাদা একটা হেডব্যাণ্ড লাগিয়েছে মাথায়। বায়ে মোড় নিল লোকটা। এই রাস্তাও মুসার পরিচতি। পটার বোনহেডের বাড়ির দিকে যাচ্ছে গাড়িটা।
আগের মতই এখনও খুলে রয়েছে বোনহেডের বাড়ির সদর দরজা। ক্যামারো থেকে নেমে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা। কিশোর আর মুসাও ছুটল। পেছনে।
ভোর হয়ে আসছে। তাজা বাতাসে অনেকটা ঠিক হয়ে গেছে দুজনের মাথার যন্ত্রণা, ঘোলাটে ভাবটা দূর হয়ে গেছে। মোমের আলো জ্বলছে বিরাট বাড়িটার ঘরে। আলো লেগে ঝিকঝিক করছে ফটিক। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢুকতে লাগল গোয়েন্দারা, বোনহেডকে খুঁজছে।
ইঁদুর মনে হচ্ছে নিজেকে, মুসা বলল, ফাঁদের দিকে যাচ্ছি।
যাইই না। পনির থাকতেও পারে।
হঠাৎ একটা দরজা খুলে গেল। বড় একটা ঘরের ভেতর শত শত মোম। জ্বলছে। সাথে করে এক যুবক আর এক মহিলাকে নিয়ে বেরিয়ে এল বোনহেড। দুজনের বয়েসই বিশের কোঠায়।
এত রাতে আমাদের সাথে দেখা করেছেন, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, লোকটা বলল। একটা চেক বাড়িয়ে দিয়েছে বোনহেডের দিকে। যাই। আরও মক্কেল এসেছে দেখি?
সত্য সন্ধানীরা তাদের হাতঘড়ি হারিয়ে ফেলেছে, বোনহেড বলল রহস্যময়। কণ্ঠে, তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর মুসার দিকে, চোখে বিচিত্র দৃষ্টি।
আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে যদি লিখে রাখতে পারতাম, মহিলা বলল, ভবিষ্যতে কাজে লাগত। যাই হোক, আপনি যে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছেন, তাতে আমি কৃতজ্ঞ। ওর জন্মদিনটা আনন্দে কাটুক, ও খুশি থাকুক, এটাই আমি চেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। গুড নাইট।
দুজনে বেরিয়ে গেলে গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হাসি হাসল বোনহেড। স্ফটিকগুলো পাওনি তোমরা। বুঝতে পারছি।
না, পাইনি, নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই অবাক হলো মুসা, কেমন খড়খড়ে হয়ে। গেছে। গোরস্থান থেকে এলাম।
এখন এসেছি অন্য জিনিস খুঁজতে, কিশোর বলল, সাদা হেডব্যাণ্ড পরা একজন লোককে।
চারপাশে তাকাল বোনহেড। ওরকম কাউকে তো দেখছি না।
তৃতীয় নয়ন ব্যবহার করুন, মুসা বলল।
ওর পেছন পেছন এখানে ঢুকেছি আমরা, বলল কিশোর।
মুখের ভাব বদলে গেল বোনহেডের, যেন মিথ্যে বলে ধরা পড়ে গেছে। ও, তোমরা নিকের কথা বলছ বোধহয়। আমার ছাত্র। ওকে কি দরকার?
একটু আগে আমাদেরকে জ্যান্ত কবর দিতে চেয়েছিল, ভারি গলায় বলল কিশোর। ড্যালটন সিমেট্রিতে গিয়েছিলাম ডিলনের স্ফটিকগুলো খুঁজতে। মাথার পেছনে বাড়ি মেরে আমাদের বেহুশ করে ফেলে দেয় আপনার ছাত্র, তারপর মাটি দিয়ে ভরে দিতে চায়।
নিক? মোলায়েম গলায় ডাকল বোনহেড। শুনে যাও তো?
হলের দরজায় এসে দাঁড়াল সাদা হেডব্যাণ্ড পরা যুবক।
এই লোকই, বলে উঠল মুসা। মুঠো হয়ে গেল হাত। ভদ্রতার ধার দিয়েও গেল না। চেঁচিয়ে উঠল, এই, আমাদের পিছু নিয়েছিলে কেন? বাড়ি মেরেছিলে কেন?