ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল মিল্ক শেকে, কিশোর। বাজি রেখে বলতে পারি বোনহেডই করেছে এই অকাজ। চট করে চারপাশে চোখ বোলাল একবার মুসা।
মিল্ক শেকের গ্লাস খুঁজছ? কিশোর বলল, পাবে না। এখানে আনিইনি। কমিশারিতে বেঞ্চের ওপর রেখেছিলাম। এখন গেলে পাবে না। পটার বোনহেডের সঙ্গে আরেকবার কথা বলতে হবে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়।
পটার বোনহেডকে খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। ডিরেকটরির হলুদ পাতাগুলোর একটাতে নিচের দিকে রয়েছে ওর বিজ্ঞাপন, লস অ্যাঞ্জেলেসের ঠিকানায়। ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞাপন। হেডিঙের বাংলা করলে দাঁড়ায় আধিভৌতিক পরামর্শদাতা। নিচে ফলাও করে লিখেছে, কত রকমের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তার। মানুষের মনের কথা পাঠ করা থেকে শুরু করে জটিল রোগের চিকিৎসা করা পর্যন্ত সব নাকি পারে। লিখেছে পৃথিবী হল আমার জবাব জানার যন্ত্র। আমার জন্যে মেসেজ রেখে দেয়। আমার প্রশ্নের জবাব দেয়। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি।
ঠিকানা দেখে বেভারলি হিলের একটা র্যাঞ্চ হাউসে এসে পৌঁছল কিশোর আর মুসা। সাদা রঙের একটা লম্বা বাড়ি। সামনের দরজাটা খুলে আছে হাঁ হয়ে। ভেতরে দামি দামি আসবাবপত্র, ছবি রয়েছে। চোরের লোভ হতে পারে, কিন্তু পরোয়াই করে না যেন বাড়ির মালিক।
খোলা দরজার পাল্লায় টোকা দিল দুই গোয়েন্দা, সাড়া এল না। থাবা দিল, তাতেও জবাব নেই। শেষে ঢুকেই পড়ল ভেতরে, চলে এল পেছন দিকে। একটা সুইমিং পুলের কিনারে বসে সন্ধ্যার উষ্ণ বাতাস উপভোগ করছে বোনহেড। খোলা গা। সাদা একটা লিনেনের প্যান্ট পরনে। পদ্মাসনে বসেছে। চাঁদ উঠছে। বড় একটা তারা ঝিলমিল করছে আকাশে, যেন সুইমিং পুলের পানির মতই।
কিশোর, লোকটাকে কোথাও দেখেছি, মুসা বলল ফিসফিসিয়ে।
তা তো দেখেছই। কয়েক দিন আগে, শুটিং স্পটে। একটা স্ফটিক দিয়েছিল তোমাকে।
না, ওখানে নয়, অন্য কোথাও দেখেছি।
শ্রাগ করল কিশোর। পেশীবহুল শরীর লোকটার। সোনালি চুল। আস্তে আস্তে ওর দিকে এগোতে লাগল সে।
চারটে বড় নীল স্ফটিক নিজের চারপাশে রেখে দিয়েছে বোনহেড। ওগুলোর একেকটাকে একেকটা কোণ কল্পনা করে কল্পিত বাহু আঁকলে নিখুঁত একটা বর্গক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। হাতের তালুতে লাল একটা পাথর। কানের ফুটোতে দুটো সাদা পাথর, আর নাভিতে একটা সোনালি পাথর বসিয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ।
মিস্টার বোনহেড, কিশোর বলল, যে আলোচনাটা শেষ করতে পারিনি। আমরা, সেটা এখন শেষ করতে চাই।
চোখ না মেলেই বোনহেড বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কানে স্ফটিক ঢোকানো রয়েছে।
নতুন যুগ। পুরানো রসিকতা, বিড়বিড় করল কিশোর।
আমার কানের স্ফটিকগুলো সমস্ত না-বোধক কাঁপন সরিয়ে রাখছে, তাতে মনের গভীরের সব বোধ সহজেই বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে। বলে দিচ্ছে, এখন যা আছি তা না হয়ে অন্য কেউ হলে কি হতে পারতাম। ওই বোধই আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে, বিষ ঢুকেছে তোমার শরীরে।
স্ফটিক আপনাকে একথা বলছে, আমাকে অন্তত বিশ্বাস করাতে পারবেন না, কিশোর বলল। আমি ভাল করেই জানি, আপনিই বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মিল্ক শেকের গ্লাসে কি মিশিয়েছিলেন বলুন তো?
শব্দ করে হাসল বোনহেড। পদ্মাসন থেকে উঠে নতুন করে সাজাতে লাগল চারপাশে রাখা স্ফটিকগুলো। ছটা বাজে। আমার সাঁতারের সময় হয়েছে। বলেই পুলের কিনারে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।
তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা।
পানিতে দাপাদাপি করছে বোনহেড। একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। চোখ। বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, মুখ গোল, মুখের ভেতরে পানি ঢুকে যাচ্ছে।
সাঁতার ভাল জানে না লোকটা, কিশোর বলল।
একেবারেই জানে না! বুঝে ফেলেছে মুসা। একটানে জুতো খুলে ফেলেই ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে। কয়েক সেকেণ্ডেই পৌঁছে গেল খাবি খেতে থাকা লোকটার কাছে। পেছন থেকে গলা পেঁচিয়ে ধরে টেনে আনতে লাগল কিনারে। পানিতে ডোবা মানুষকে কি করে উদ্ধার করতে হয়, ভালই জানা আছে তার।
ভারি শরীর। দুজনে মিলে কসরৎ করেও বোনহেডকে পানি থেকে তুলতে কষ্ট হলো কিশোর আর মুসার।
বোনহেড কথা বলার অবস্থায় ফিরে এলে কিশোর জিজ্ঞেস করল, একাজ করতে গেলেন কেন? আমরা না থাকলে তো ডুবে মরতেন।
গতকাল তো তোমরা ছিলে না। ঠিকই সাঁতার কেটেছি। কই, মরিনি তো।
আপনার মাথায় দোষ আছে! রাগ করে বলল কিশোর, আর একটা মিনিটও আমরা থাকব না এখানে! যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই, শুনুন, বেন ডিলনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আমার সন্দেহ, আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন। আমাদেরকে বলছেন না। না বললে নেই, আপনার ইচ্ছে। কিন্তু ভাববেন না, এতে করে আটকাতে পারবেন আমাদেরকে। ঠিক খুঁজে বের করে ফেলব। আমরা ডিলনকে।
বোনহেডের চেহারার পরিবর্তনটা মুসারও নজর এড়াল না। ঠিক জায়গায় ঘা মেরেছে কিশোর। কিন্তু মুহূর্তে সামলে নিল ভবিষ্যদবক্তা। হাসি ফুটল ঠোঁটে। ডিলন কোথায় আছে আমি তোমাদেরকে বলতে পারব না। তবে ডিলন আমাকে বলতে পারবে সে কোথায় আছে।
আপনার সঙ্গে সে যোগাযোগ করবে আশা করছেন নাকি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
ডিলন আমার ছাত্র। ছাত্র হলেই প্রথমে আমি ওদেরকে প্রয়োজনীয় স্ফটিক দিয়ে দিই। স্ফটিকগুলো সব আমার দিকে টিউন করা। কিংবা বলা যায়, আমরা। যারা এই গ্রুপে আছি, তাদের সবার দিকে টিউন করা। আমাদেরকে চেনে ওগুলো। আমাদের চিন্তা পড়তে পারে, আমাদের স্বপ্ন বুঝতে পারে। কি পোশাক আমাদের পরা উচিত তা-ও বলে দিতে পারে। আমরা বহুদূরে চলে গেলে আমাদের জন্যে মন কেমন করে ওগুলোর। নিঃসঙ্গ বোধ করে।