লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আবার মুসা। পাগল হয়ে গেছে যেন। কিশোরের কাটা গলার দিকে তাকাতে পারছে না। কাউকে ডেকে আনবে কিনা ঠিক করতে পারছে না এখনও। নড়ছে না কিশোর, মরেই গেছে সম্ভবত…
মুসার মনে হতে লাগল, দেয়াল চেপে আসছে চারপাশ থেকে, নিচে নেমে আসছে ছাত। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবার চিৎকার করে উঠল, কিশোর, বলো কিশোর, কে?… তাকাল কিশোরের গলার দিকে। আরি, রক্ত বেরোচ্ছে না। কেন?
বসে পড়ল আরেকবার। গলার পাশের মাটিতে আঙুল ছোঁয়াল। এক ফোঁটা রক্ত নেই, ধুলো লাগল আঙুলে। কাঁপা কাঁপা হাতে কিশোরের কাটা জায়গাটা ছুঁয়ে। দেখল।
ভেজা নয়! রবার!
মেকাপ! আরেকবার চিৎকার করল মুসা, দুঃখে নয় এবার, রাগে। কিশোরের গায়ে জোরে একটা ঠেলা মেরে খেঁকিয়ে উঠল, অনেক হয়েছে! এবার ওঠো! এত শয়তানী করতে পারো…
নড়ল না কিশোর। আরেকবার ঠেলা দিল মুসা। একই ভাবে পড়ে রইল গোয়েন্দাপ্রধান। সন্দেহ হতে লাগল মুসার। রসিকতা নয়। সত্যিই কিছু হয়েছে। কিশোরের। ভাড়াতাড়ি ওর গলার নাড়িতে আঙুল চেপে ধরে দেখল ঠিক আছে। কিনা। নাড়ি চলছে ঠিকই। নড়ছে না যখন, তার মানে বেহুঁশ হয়ে গেছে কিশোর। কি ঘটেছিল?
বসে রইল মুসা।
আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করল কিশোরের মাথা, একপাশ থেকে আরেক পাশে। মৃদু গোঙানি বেরোল শুকনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। চোখ মেলল অবশেষে।
জেগেছ, এতক্ষণে হাসি ফুটল মুসার মুখে। ওঠো ওঠো।
মুসার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। নড়ছেও না কথাও বলছে না।
কথা বলতে ভুলে গেছ নাকি?
শশশ, চুপ করতে ইঙ্গিত করল মুসাকে কিশোর। কি ঘটেছিল, মনে করার চেষ্টা করছি।
জোরে জোরেই করো না, আমিও শুনি।
উঠে বসল কিশোর। টলছে। দাঁড়াও… জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে ভিজিয়ে নিল সে। ইনডোর শূটিঙের জন্যে যেখানে সেট ফেলেছেন রিডার, সেখানে ঘোরাঘুরি করছিলাম। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললাম। কিছু মূল্যবান তথ্য দিল ওরা আমাকে।
বেন ডিলনের ব্যাপারে?
না, শরীর ঠিক রাখার ব্যাপারে। সিনেমায় যারা অভিনয় করে, শরীরটাই তাদের প্রধান পুঁজি, নষ্ট হয়ে গেলে মরল।
ধূর! ওসব কথা শুনতে চায় কে? আমাকে জিজ্ঞেস করতে, কিভাবে ফিট রাখতে হয় আমিই বলে দিতাম।
মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। প্রোটিন মিল্ক শেক খায় ওরা, মুসা। এটা খেয়েই শরীরের ওজন কমিয়ে রাখে। ওরা বলে, সাংঘাতিক নাকি কাজের জিনিস। মনে হলো, আজ থেকেই আমিও শুরু করি না কেন? পেটে মেদ জমাকে আমার ভীষণ ভয়। চলে গেলাম স্টুডিওর কমিশারিতে এক গ্লাস মিল্ক শেক খাওয়ার জন্যে। ড্রিংক আসার অপেক্ষায় আছি, এই সময় খেয়াল করলাম বিশালদেহী, একজন লোক আমার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। এমন ভাব করে রইলাম, যেন তাকে দেখিইনি। মিল্ক শেক নিয়ে বেরোতে যাব, দরজায় দাঁড়িয়ে আমার পথ আটকাল সে।
একটা মুহূর্ত একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর সে বললঃ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমরা যেটা খুঁজে পেয়েছি সেটা নয়, যেটা আমরা খুঁজতে যাচ্ছি সেটা।
বলল ওরকম করে? মাথা নাড়তে নাড়তে বলল মুসা, তোমাকেও ধরেছে! বুঝতে পেরেছি, কে। পটার বোনহেড।
হ্যাঁ। উঠে দাঁড়াল কিলোর। এগোতে গিয়ে টলমল করে উঠল পা। কয়েক কদম এগিয়েই থেমে গেল। পড়ে গেলে যাতে ধরতে পারে সে জন্যে হাত বাড়িয়ে। দিল মুসা।
ঠিকই আছি, আমি পারব, কিশোর বলল, ধরতে হবে না। যা বলছিলাম। মিল্ক শেক নিয়ে তখুনি বেরোলাম না আর। মনে হলো, এই লোক আমাকে অনেক, খবর দিতে পারবে। প্রশ্ন শুরু করলাম তাকে। অনেক কথাই বলল সে, তবে। আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। শেষে কিছুটা বিরক্তই হয়ে গেলাম। ওরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বললে কি ভাল্লাগে নাকি! জিজ্ঞেস করলাম, শেষ কখন ডিলনকে দেখেছে। জবাব দিল, রোজই।
বললাম, কি আবল-তাবল বকছেন? শেষ কোথায় দেখেছেন?
জবাব দিল, আমার তৃতীয় নয়ন সারাক্ষণই দেখে তাকে।
বলো, কি রকম যন্ত্রণা! তৃতীয় নয়ন! নিজের কপালে যে দুটো আছে সে দুটোই ভালমত ব্যবহার করতে শেখেনি, আবার তৃতীয় নয়ন। হুহ! রাগ হতে লাগল। তার পরেও জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আছে এখন বেন ডিলন? ঘুরিয়েই হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এই সময় সেখানে এসে হাজির হলেন ব্রাউন অলিংগার। চিনে ফেললেন আমাকে। কি কুক্ষণেই যে মোটুরামের অভিনয় করতে গিয়েছিলাম! বললেন, হরর ছবিতে নতুন চরিত্র যোগ করতে যাচ্ছেন তিনি, আমি ইচ্ছে করলে তার সঙ্গে কাজ করতে পারি। কাজ মানে অভিনয়, বুঝতে পারলাম।
গলা থেকে কুৎসিত কাটার দাগ আঁকা রবারটা টেনে খুলে ফেলল কিশোর। চামড়া থেকে এবার সিমেন্ট ছাড়াতে বেশ জোরাজুরি করতে হলো। কি করতে হবে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, কয়েকটা শট নেয়া হবে, তারই একটা মহড়া। চলবে। আমাকে দিয়ে হলে আমাকেই নেবে, নয় তো অন্য কাউকে। অলিংগারের সঙ্গে কথা বলা যাবে, এই লোভেই কেবল ওদের গিনিপিগ সাজতে রাজি হয়ে গেলাম। ভুল করেছি। মেকআপের ঘরে আমাকে নিয়ে গিয়ে রেখে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে এলেন কাজ কতটা এগোল দেখার জন্যে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অ্যালার্ম দিতে শুরু করল ঘড়ি, প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন তিনি।
তুমি তখন কি করলে? জানতে চাইল মুসা।
কমিশারিতে ফিরে গেলাম। যেখানে বোনহেড আর আমার গ্লাসটা রেখে। এসেছিলাম। গ্লাসটা ঠিকই আছে, কিন্তু বোনহেড নেই। খেয়ে গ্লাসটা খালি করে রেখে চলে এলাম এখানে। তারপর কি ঘটল, মনে নেই। চোখ মেলে দেখি তোমাকে।