পঅজ বাটনটা টিপে দিল কিশোর। স্থির হয়ে গেল মূর্তি। ভয়াবহ মুখটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল সে।
মুখের রঙ ফসফরাসের মত সবুজ, তেমন করেই জ্বলে। লাল চোখ। গলার কাছে কালো গর্ত। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যেন অস্থির, দেহের ভেতরের সমস্ত যন্ত্রপাতি বেরিয়ে আসতে চাইছে, সেই ব্যথারই ছাপ পড়েছে মুখে।
খাইছে! নিচু গলায় বলল মুসা। জোরে বলার সাহস হারিয়েছে।
পঅজ রিলিজ করে দিল কিশোর। পেছনে, আশেপাশে তাকাতে লাগল মূর্তিটা। কয়েকবার করে তাকিয়ে যখন নিশ্চিত হল তাকে কেউ লক্ষ করছে না, তখন একটা পা তুলে জোরে এক লাথি মারল ট্রেলারের দরজায়। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল লোকটা। ক্যামেরার চোখ থেকে সরে যাওয়ায় দেখা গেল না তাকে। কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে আলখেল্লার কোণ উড়িয়ে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
লোকটা কে? রবিনের প্রশ্ন।
মানুষ তো? মুসার প্রশ্ন।
কয়েকবার করে টেপটা চালিয়ে দেখল ওরা। প্রতিবারেই নতুন কিছু না কিছু চোখে পড়ল।
ব্যাটার শ্বদন্ত আছে, রবিন বলল।
ডান হাতের আঙুলে একটা আঙটি, বলল কিশোর। বড় একটা পাথর বসান।
অদ্ভুত মূর্তিটার সব কিছুই যখন দেখা হয়ে গেল, আর কিছুই বাকি রইল না, যন্ত্রটা অফ করে দিল কিলোর।
চালাকিটা ভালই করেছে, মুসা মন্তব্য করল। হ্যালোউইনের রাতে ভ্যাম্পায়ারের সাজ সেজে এসেছে, কেউই লক্ষ্য করবে না ব্যাপারটা। আজকের রাতে ওরকম ছদ্মবেশ পরে খুন করেও পার পাওয়া যাবে, ধরা পড়তে হবে না।
এবার একটা প্ল্যান করা দরকার, কিশোর বলল। মুসা, কাল আমাদেরকে স্টুডিওতে নিয়ে যাবে তুমি। লোকের সঙ্গে কথা বলে দেখব, ডিলনকে কে বেশি চেনে। শেষ কে দেখেছিল, জানব। বোঝার চেষ্টা করব, কার কার নাম সন্দেহের তালিকায় ফেলতে হবে।
পরদিন স্কুল শেষ করে স্টুডিওতে গিয়ে প্রথম যে মানুষটার সামনে পড়ল তিন গোয়েন্দা, তিনি মুসার বাবা রাফাত আমান। ভয়ঙ্কর একটা মুখোশ পরে স্টুডিও লট ধরে হেঁটে চলেছেন।
তোমরা? একেবারে সময়মত এসেছ, আমান বললেন। আমার ইফেক্টগুলো কেমন আসবে, দেখতে যাচ্ছি। দেখার ইচ্ছে আছে? ডেইলি।
না বলার কোনই কারণ নেই। আমানের পিছু পিছু একটা প্রাইভেট স্ক্রিনিং রুমের দিকে চলল ওরা। রবিন জিজ্ঞেস করল, ডেইলিটা কি? দৈনিক কোন ব্যাপার না তো?
তা-ই। শুটিং করা প্রতিদিনকার অংশকে ডেইলি বলে ফিল্মের লোকেরা, বাবার হয়ে জবাবটা দিল মুসা। দিয়ে গর্বিত হলো, রবিনের চেয়ে এ ব্যাপারে বেশি জানে বলে। এডিট করা হয় না তখনও, প্রচুর ভুলভাল থেকে যায়।
স্ক্রিনিং রুমটাকে খুদে একটা সিনেমা হলই বলা চলে। ছয় সারি সীট। লাল মখমলে মোড়া গদি। সামনের সারির প্রতিটি সীটের ডান হাতলে রয়েছে। ইনটারকমের বোতাম। ওখানকার একটা সীটে বসে বোম টিপে দিলেন আমান। প্রেজেকশনিস্টকে ছবি চালাতে বললেন।
হলের আলো কমিয়ে দিয়ে ছবি চালানো হলো।
আগের হপ্তায় ভোলা স্পেশাল ইফেক্টের ছবিগুলো দেখতে লাগল তিন গোয়েন্দা। প্রতিটি দৃশ্যেই জ্যাক রিডারের ছাপ স্পষ্ট, ভয়ঙ্কর বীভৎস করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
একটা দৃশ্যে একটা বাচ্চা ছেলে বার বার হেঁচকি তুলছে।
কি করে সারাতে হয় জানি আমি, বলল বাচ্চাটার মা, স্বাভাবিক মানুষ নেই। আর, জোম্বি হয়ে গেছে। ভয় দেখাতে হবে। আর কোন উপায় নেই।
বলেই একটানে বাচ্চাটার একটা হাত ছিঁড়ে ফেলল। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। কাঁধের কাছের ছেঁড়া জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।
দেখলে তো? হেঁচকি বন্ধ।
কাট! শোনা গেল রিডারের কণ্ঠ, ক্যামেরার চোখের বাইরে থেকে। আর কবে শিখবে? কিছুই তো বলতে পারো না।
আরেকটা দৃশ্যে নাকে রুমাল চেপে হাঁচি দিল একটা লোক। তারপর আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইল রুমালের দিকে, হাচির চোটে তার নিজের মগজই নাক দিয়ে বেরিয়ে এসে রুমালে লেগে গেছে।
রবিনের দিকে কাত হয়ে তার কানে কানে কিশোর বলল, জ্যাক রিডার একটা চরিত্র বটে!
স্যাডিস্ট! ফিসফিসিয়ে জবাব দিল রবিন।
তারপর বেন ডিলনের অভিনীত কয়েকটা দৃশ্য চলল। সে নিজেই জোম্বিতে পরিণত হল, চোখের কোণে কালো দাগ পড়ল। রঙ দিয়ে করা হয়েছে ওগুলো।
বাবা, পর্দায় বলছে ডিলন, তুমি আমাকে হার্ভার্ডে পাঠাতে চাও তো। যেতে ইচ্ছে করে না। আমার ভাল লাগে লোকের গলা কামড়ে ছিঁড়ে মাথা আলাদা করতে।
স্ক্রিপ্ট লিখেছে কে? জোরে জোরেই বলল মুসা, মাথায় খালি কুৎসিত চিন্তা…
চুপ, থামিয়ে দিলেন ওকে আমান। আমার চাকরিটা খাবে নাকি?
নতুন আরেকটা দৃশ্যে দেখা গেল ডিলন আর একজন সুন্দরী অভিনেত্রীকে। মেয়েটা খাট, কোঁকড়া কালো চুল, চোখের পাপড়িও কোকড়া।
অ্যাঞ্জেলা ডোভার না? সামনে ঝুঁকে আমানকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। এই ছবির সহ-অভিনেত্রী। তবে অনেক দেখান হয় ওকে, শুরুতেই টানা বিশ মিনিট। ডেটিং করে ডিলনের সঙ্গে। এই দৃশ্যে দেখান হবে নিরীহ, গোবেচারা, ভালমানুষ, কিছুটা বোকাও। ভাবতেই পারেনি ওপরতলা থেকে দুটো। মানুষের বাচ্চাকে খেয়ে এসেছে ডিলন।
বিশ্বাস কর, ডানা, ডিলন বলছে, কেমন জানি হয়ে গেছি আমি। অদ্ভুত অনুভূতি। দম নিতে কষ্ট হয়। মনে হয়, কবরে শুয়ে আছি, বেলচা দিয়ে মাটি ছিটান হচ্ছে আমার ওপর, ঢেকে দেয়ার জন্যে। মনে হয়, একের পর এক মানুষ খুন করি।