পাইন গাছটার কাছে পৌঁছলো ওরা।
ওই যে দেখো, জনি বললো, পুকুর।
পানির রঙ দেখেই বোঝা গেল পুকুরটা গভীর। ঘন নীল, ঠাণ্ডা, কাঁচের মতো মসৃণ পানির উপরিভাগ। একপাড়ে ঘন গাছের সারি। একেবারে পানির কিনারে নেমে গেছে একধরনের ছোট জাতের উদ্ভিদ।
এগিয়ে গেল দলটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো গাছের গায়ে লাগানো একটা নোটিশ দেখে। লেখা রয়েছেঃ
কীপ আউট
ডেনজার
গভার্নমেন্ট প্রোপার্টি
সরে থাকতে বলছে। বিপদ! সরকারি জায়গা! অবাক হয়ে বললো মুসা। এর মানে কি?
দূর, হাত নাড়লো জনি। ওই নোটিশকে পাত্তা দিও না। ও কিছু না।
৫
কি বলো? কথাটা ধরলো কিশোর, কিছু না-ই যদি হবে, তাহলে লিখেছে কেন?
ওরকম নোটিশ এই এয়ারফীন্ডের আশেপাশে অনেক দেখতে পাবে, হালকা গলায় বললো জনি। বিপদ আছে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়ে সরে থাকতে বলেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা বিপদও দেখিনি আমি। শুধু প্লেন আছে, কামান-বন্দুকবোমা কিছু নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাকি অনেক এয়ারফীন্ডের পাশে মাইন পড়ে থাকতে দেখা গেছে, এখানে তা-ও দেখিনি।
তাহলে নোটিশ লিখেছে কেন? মুসাও ধরলো। তোমার খালাতো ভাইকে জিজ্ঞেস করলেই পারো। লিখেছে যখন, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
বললাম তো, নেই, জোর দিয়ে বললো জনি। জন্মের পর থেকেই ওই নোটিশ দেখে আসছি। একসময় হয়তো লাগিয়েছিলো কোনো কারণে, এখন সেই কারণটা আর নেই। এখানে এসে গোসল করি, যা খুশি করি আমরা। কেউ কিছু বলে না।
বেশ মেনে নিলাম তোমার কথা, বললো বটে কিশোর, কিন্তু মানতে যে পারেনি সেটা তার স্বরই জানিয়ে দিলো। এখানে নোটিশ লাগানোর কোনো কারণ অবশ্য আমিও দেখছি না। কাঁটাতার নেই, বেড়া নেই, কিছুই নেই। শুধু নোটিশ লিখে রাখলেই কি আর লোকে মানবে?
ওসব কথা বাদ দিয়ে এখন এসো, পানিতে নামি।
সুইমস্যুট পরে ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়লো ওরা। যতটা ভেবেছিলো, তার চেয়ে গভীর। চমৎকার ঠাণ্ডা, এই গরমে বেশ আরামদায়ক। কুকুরদুটোও তীরে থাকলো না, ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে। মজা পেয়ে দাপাদাপি করতে লাগলো। রাফি তো উত্তেজনায় চেঁচাতেই শুরু করলো।
এই রাফি, চুপ! ধমক দিলো জনি।
কেন, চুপ করবে কেন? কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো জিনা।
এয়ারফীন্ডে কেউ থাকলে শুনতে পাবে।
শুনুক না, অসুবিধে কি? তুমি তো বললে নোটিশ এমনি এমনিই লিখেছে।
আর কিছু বললো না জনি।
রাফির দেখাদেখি কিছুক্ষণ পর ডবিও চেঁচাতে শুরু করলো। আবার ধমক লাগালো জনি, এই ডবি, চুপ করলি। মারবো কষে এক থাপ্পড়!
কিন্তু ডবি চুপ করার আগেই ঘটে গেল আরেক ঘটনা। ধমক দিলো একটা কণ্ঠ, উঁচু গলায় কথা বলা স্বভাব লোকটার, এই, হচ্ছে কি! সরকারি এলাকায় অন্যায় ভাবে ঢুকেছে। নোটিশ দেখোনি?
চিৎকার থামিয়ে দিলো কুকুর দুটো। কে কথা বলে দেখার জন্যে ঘুরে তাকালো সবাই।
এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম পরা একজন লোক, বিশালদেহী, মোটা, লাল মুখ।
কি হয়েছে? লোকটার দিকে সঁতরে এগোলো কিশোর। আমরা গোসল করছি। কোনো ক্ষতি করছি না।
নোটিশ দেখোনি? গাহের দিকে হাত তুললে লোকটা।
দেখেছি। কিন্তু এখানে তো কোনো বিপদ দেখছি না, নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছে করলো কিশোরের, নোটিশ দেখেও জনির কথা বিশ্বাস করেছে বলে।
উঠে এসো! গর্জে উঠলো লোকটা। সব্বাই।
ধীরে ধীরে পানি থেকে উঠে এলো সবাই। কুকুর দুটো উঠে গা ঝাড়া দিয়ে তাকালো লোকটার দিকে।
এই কুত্তাদুটোকেই ঘেউ ঘেউ করতে শুনেছি তাহলে? তোমরা তো ছোট নও, নোটিশ বোঝার বয়েস হয়েছে। তারপরেও অমান্য করলে কেন? উপদেশ দিতে আরম্ভ করলো লোকটা, যা সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করে কিশোর। চেঁচামেচি শুনে ভাবলাম, কেউ হয়তো বিপদে পড়েছে। তাই দেখতে এসেছি।
এখন তো দেখলেন পড়িনি, মুখ কালো করে বললো জনি।
পড়নি, কিন্তু পড়তে পারতে। এই ছেলে, তোমাকে আগেও দেখেছি মনে হয়? তুমি আর ওই কুত্তাটাকে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হ্যাঙারের ওধার থেকে বেরিয়ে নিষিদ্ধ এলাকা দিয়ে চলেছিলে।
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, আমার খালাতো ভাই ফাইট-লেফটেন্যান্ট জ্যাক ম্যানরের সঙ্গে দেখা করতে, কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই বললো জনি। সেটা কি দোষের নাকি? সেদিনও বলেছি, আজও বলছি, শাইং করতে যাইনি। আর করার আছেই বা কি ওখানে? আমি শুধু আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম।
বেশ, আমিও দেখা করবো তার সাথে। দেখা করে বলবো, ভালোমতো ধোলাই দেয় যেন তোমাকে। বড় বেশি ফড়ফড় করো! চোখের মাথা খেয়েছো নাকি? চারদিকে নোটিশ ছড়িয়ে আছে দেখোনি?
তারমানে কি তলে তলে জরুরী কিছু ঘটছে? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসলো জনি।
ঘটলে যেন বলবো তোমাকে! বিরক্ত কণ্ঠে বললো লোকটা। এখানে বিপদের কিছু নেই আমিও জানি। ঝর্নার পানি এসে জমা হয় এই পুকুরে, মাছটাছও জিয়ানো নেই যে নষ্ট হবে। তাছাড়া লোকে এখানে পিকনিক করতে এসে জায়গাটাকে সরগরম করে তুললে ভালোই লাগতো, যা নীরব হয়ে থাকে! কিন্তু সেটা করতে দিতে পারি না। আমার ওপর আদেশ রয়েছে কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়া হয়।
লোকটা ঠিকই বলছে, ভাবলো কিশোর। জনি তর্ক করছে অযথা। নোটিশ অমান্য করে ওরাই বেআইনী কাজ করেছে। উচিত হয়নি। বললো, দেখুন, আমরা সত্যি অন্যায় করেছি। গরম লাগছিলো তো, ঠাণ্ডা পানির কথা শুনে লোভ সামলাতে পারিনি। গোসল করতে চলে এসেছি। ঠিক আছে, আর আসবো না।