ব্যস, আর কিছু বলতে হলো না। সবাই মথ খুঁজতে আরম্ভ করলো ঝোপেঝাড়ে। প্রজাপতি ধরা খুব ভালো লাগছে ওদের। রাফি আর ডবিও বেশ আগ্রহী। এখানে ওখানে ওকে বেড়াতে লাগলো। কিছুই না পেয়ে আবার আগের জায়গায় এসে জমায়েত হলো সকলে। তারপর আবার এগোনোর পালা।
এমনি করে পথে পথে থেমে, প্রজাপতি ধরে এগোতে অনেক সময় লাগলো। যতোটা লাগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগিয়ে, অনেক দেরিতে এসে প্রজাপতির খামারে পৌঁছলো দলটা।
এই কাচের ঘরেই আপনার প্রজাপতি রাখেন? জানতে চাইলো কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন ডাউসন। এসো। সব দেখাচ্ছি। কিভাবে কি করি আমি আর আমার বন্ধু ডরি। আজ অবশ্য ওর দেখা পাবে না, নেই এখানে।
জায়গাটা অদ্ভুত লাগলো দর্শকদের কাছে। কটেজটা দেখে মনে হয় যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। দুটো জানালা ভাঙা, ছাতের কয়েকটা টালি গায়েব। কিন্তু কাঁচের ঘরগুলো বেশ সুন্দর, সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রতিটি কাঁচ ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজেদের চেয়ে প্রজাপতি আর মথের যত্ন অনেক বেশি নেন প্রজাপতি মানবেরা, বোঝা গেল।
এখানে কি শুধু আপনারা দুজনই থাকেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন। এরকম একটা জায়গায় দুজন মানুষ কি করে থাকে ভাবতে অবাক লাগছে তার। একা লাগে না?
না, একা লাগবে কেন? রবিনের প্রশ্নটাই যেন অবাক করলো ডাউনকে। তাছাড়া মিসেস ডেনভার আছে, আমাদের কাজকর্ম করে দেয়। তার ছেলে এসে মেরামত-টেরামত কিছু লাগলে করে দেয়। প্রজাপতির ঘরগুলো পরিষ্কার রাখে। মিসেস ডেনভার কীট-পতঙ্গ একদম পছন্দ করে না, ঘরগুলোর কাছেই আসে না সে। কাজেই তার ছেলেকেই সব করতে হয়।
কটেজের জানালা দিয়ে উঁকি দিলো এক বৃদ্ধা। জিনার মনে হলো, বুড়ি তো নয়, রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসা ডাইনী। ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো মুসা। ভূত আর ডাইনী-পেত্নীকে যে সে ভয় পায়, একথা জানা আছে জনির। হেসে বললো, ভয় নেই, মানুষই, ভূতপ্রেত নয়। মহিলা ভালো। আমাদের রাঁধুনী মেয়েটা প্রায়ই দুধ আর ডিম দিতে আসে এখানে। সে গিয়ে সব বলে। একটা দাঁতও নেই মহিলার। ফলে চেহারাটা ওরকম বিকট লাগে। ডাইনী মনে হয়।
তোমার ভূতের ভয়টা আর দূর করতে পারলে না, রবিন বললো মুসাকে। তোমরা ডাইনীর আলোচনা নিয়েই থাকো, আমি প্রজাপতি দেখতে গেলাম।
ছোট ছোট কাচের বাক্সের ভেতরে শত শত প্রজাপতি উড়ছে। কাঁচের ঘরের মধ্যে নানা রকম গাছ লাগিয়ে ঝোপঝাড় তৈরি করা হয়েছে, বাইরে যেরকম ঝোপে ঝাড়ে থাকে প্রজাপতি, ঠিক সেরকম পরিবেশ।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কতো খুঁয়াপোকা দেখেছো? পাতা খেয়ে তো সব সাফ করে ফেললো।
হ্যাঁ, রাক্ষসের মতো খায় ওরা, ডাউসন বললেন।
অনেক ধরনের শুঁয়াপোকা দেখা গেল। কোনোেটা ভীষণ কুৎসিত, দেখলেই গায়ে কাঁটা দেয়, কোনোটা খুব সুন্দর, সারা শরীরে রঙের বাহার। যেমন, গাঢ় সবুজ পোকা, লাল আর হলুদ ফোঁটা। আরেক ধরনের আছে, বেশ বড়, সবুজের ওপর লাল আর কালো ডোরা, লেজের কাছে বাঁকা শিঙের মতো। দেখতে যেন বিকট, তেমনি সুন্দর।
প্রাইভেট-হক মথের য়াপোকা, ডাউসন জানালেন।
এর নাম প্রাইভেট-হক কেন? রবিন জিজ্ঞেস করলো ভয়ে ভয়ে। কিছু জানো না বলে যদি আবার গাল দিয়ে ওঠেন ডাউসন?
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হাসলেন প্রজাপতি মানব। বোধহয় তিনি মনে করেছেন, খুব বুদ্ধিমান ছেলেটা। কেন, হক মথ উড়তে দেখোনি কখনও? ও, দেখোনি। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ওড়ে। অনেকটা ওই হকহক চেনো তো?
চিনি। বাজপাখি।
গুড। ওই বাজপাখির মতো।
কিন্তু প্রাইভেট কেন? একা একা থাকতে পছন্দ করে বুঝি?
ঠিক ধরেছো। বুদ্ধিমান ছেলে। তবে এখানে একা থাকার সুযোগ পায় না। অন্যদের সঙ্গে একসাথেই বেড়ে উঠতে হয়।
প্রজাপতির খামার দেখতে ভালোই লাগছে ওদের।
গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে আসতে দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো মুসার। আশ্চর্য! এ-কি যাদু নাকি!
আমার কাছেও অনেক সময় যাদুই মনে হয়, হেসে বললেন ডাউসন। ডিম থেকে কিলবিলে ওয়াপোকা বেরোনো, সেই পোকার গুটিতে আশ্রয় নেয়া, তারপর সেই শুটি কেটে ডানাওয়ালা চমৎকার রঙিন প্রজাপতি বেরিয়ে আসতে দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই।
কিন্তু ভীষণ গরম এখানে, মিস্টার ডাউসন, একজিনিস আর বেশিক্ষণ দেখতে ভালো লাগছে না কিশোরের। ওদিকে বোধহয় কিছুটা ঠাণ্ডা হবে। ওদিকে গিয়ে বসি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও, বললেন ডাউসন। আমার কাজ আছে। দেখতে ইচ্ছে করলে আবার এসো।
ওখান থেকে সরে একটা ছায়ামতো জায়গায় চলে এলো ওরা। হঠাৎ পেছনে ভাঙা গলায় কথা বলে উঠলো কেউ, যাও, এখানে কি? চলে যাও।
৪
গরগর করে উঠলো রাফি আর ডবি। পাই করে ঘুরলো সবাই। ডাইনীর মতো দেখতে মহিলাটা দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ওপর এসে পড়েছে তার পাটের আঁশের মতো ফিনফিনে চুল।
কি ব্যাপার, মিসেস ডেনভার? দ্রকণ্ঠে বললো কিশোর। আমরা খামার দেখতে এসেছি। কিছু নষ্ট করব না।
করো আর না করো, সেটা ব্যাপার না, দাঁত নেই বলে সমস্ত কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মহিলার, স্পষ্ট বোঝা যায় না। বাইরের কেউ আসুক এটা আমার ছেলে পছন্দ করে না।
কিন্তু এটা নিশ্চয় আপনার ছেলের জায়গা নয়, অবাক হয়েছে মুসা। মিস্টার ডাউসন আর তার বন্ধু…
তোমাদেরকে চলে যেতে বলা হয়েছে, চলে যাও, ব্যস, ওদের দিকে মুঠো তুলে ঝাঁকালো বৃদ্ধা। আমার ছেলে পছন্দ করে না।