ভুলেই গিয়েছিলাম, উঠে বসলো আবার মুসা।
ঝর্না থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো সবাই। নাস্তা তৈরি করতে বসলো রবিন। তাকে সাহায্য করলো জিনা।
পরিষ্কার নীল আকাশ, ঝলমলে রোদ। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ঝোপের পাশে বসে বাতাস বাঁচিয়ে আগুন জ্বাললো রবিন। ডিম সেদ্ধ করলো। রুটি কেটে তাতে মাখন মাথালো জিনা। টুকরো করে টম্যাটো কেটে তাতে লবণ আর মশলা মাথালো। ঝর্নার পানিতে চুবিয়ে রাখা কয়েকটা দুধের বোতল গিয়ে নিয়ে এলো কিশোর আর মুসা।
সাধারণ খাবার। কিন্তু এই পরিবেশে বসে এসবই অমৃতের মতো লাগলো ওদের।
খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফি। ঘনঘন লেজ নাড়ছে। সবাই আন্দাজ করলো, বোধহয় জনি আসছে। হ্যাঁ, সে-ই, কারণ রাফিয়ানের ডাকের জবাবে সাড়া দিলো ডবি। একটু পরেই দেখা গেল তাকে। পাহাড়ের মোড় ঘুরে বেরিয়ে এলো। কাছে এসে লম্বা জিভ বের করে বসলো।
স্বাগত জানাতে তার গা চেটে দিলো রাফিয়ান।
জনি এলো। ও, নাস্তা করছে। এতোক্ষণে? ওদিকে কতো কাজ করে এলাম আমি। সেই ছটা থেকে শুরু করেছি। গরু দোয়ালাম, গোয়াল সাফ করলাম, হাঁসমুরগীগুলোকে খাবার দিলাম, খুপরী থেকে ডিম বের করলাম।
এখানে এসেই পুরোদস্তুর খামারওয়ালা বনে গেছো দেখছি, হেসে ঠাট্টা করলো মুসা।
হাতের ঝুড়িটা নামিয়ে রাখলে জনি। দুধ, রুটি আর ডিম পাঠিয়ে দিলো মা। বাসায় বানানো কেকও দিয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ তাকে। তোমাকেও। কিশোর বললো। কিন্তু জনি, তাঁবু আর জিনিসপত্র ধার দিয়ে এমনিতেই অনেক সাহায্য করেছে, ঋণী করে ফেলেছো। ভাই, কিছু মনে করো না, খাবারের দামটা অন্তত দিতে দাও।
মা নেবে না। বললেই রাগ করবে।
কিন্তু আমরাই বা তোমাদের কাছ থেকে পয়সা ছাড়া কতো নেবো? রবিন বললো।
নিতে খারাপ লাগবে, বললো মুসা। বুঝতে পারছে না…
পারছি। কিন্তু মাকে আমি বলতে পারবো না, জনি হাতজোড় করলো। আমি মাপ চাই। পারলে তোমরা দাও গিয়ে।
মুশকিলই হলো দেখছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর।
এক কাজ করা যায়, প্রস্তাব দিলো জিনা। যতোবার খাবার আনবে, ততোবার কিছু কিছু করে পয়সা দেবো আমরা তোমার হাতে। তুমি সেগুলো নিয়ে রেখে দেবে একটা বাক্সে। তারপর আমরা চলে যাবার দিন, কিংবা পরে উপহার কিনে তাকে দেবে। আমাদের তরফ থেকে। তাহলে আর তিনি মাইন্ড করতে পারবেন না। কি, ঠিক আছে?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো জনি। হুঁ, তা দেয়া যায়। তবে তোমরা পয়সা না দিলেই আমরা খুশি হতাম। যাকগে, এখন এগুলো তোমাদের ভাঁড়ারে তুলে রাখো তো।
খাবার রেখে আসা হলে কিছু টাকা বের করে জনির হাতে দিয়ে কিশোর বললো, কালকের আর আজকের খাবারের দাম।
টাকাটা পকেটে রেখে দিয়ে জনি বললো, তা আজ কি করবে ঠিক করেছে কিছু? প্রজাপতির খামার দেখতে যাবে, না আমাদের খামার?
তোমাদের খামারে তো গেছিই কাল একবার, পরে যেতে পারবো যখন খুশি, কিশোর বললো। অন্যদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, আজ কি করা যায় বলো তো? এমন ঝলমলে রোদ ফেলে কালো গুহাগুলোতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। গুহায় নাহয় আরেকদিন ঢোকা যাবে, কি বলো?
কেউ জবাব দেয়ার আগেই হঠাৎ সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো রাফি আর ডবি। একই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বড় একটা ঝোপের দিকে।
কে এলো? জিনা বললো। এই রাফি, দেখ তো কে?
ছুটে গেল রাফিয়ান আর ডবি। একটা বিস্মিত কণ্ঠ কানে এলো। এই যে ডবি? এখানে এসে উঠেছিস কেন? তোর বন্ধুটি কে?
মিস্টার ডাউসন, জনি জানালো। প্রজাপতির খামারের এক মালিক। জাল নিয়ে প্রায়ই আসে এখানে, প্রজাপতি ধরতে।
ঝোপ ঘুরে বেরিয়ে এলেন একজন মানুষ। আলুথালু পোশাক, চশমাটা বারবার নাকের ওপর থেকে পিছলে পড়তে চায়। চুল-দাড়িতে কতোদিন নাপিতের কাঁচি লাগেনি কে জানে। হাতে একটা প্রজাপতি ধরার জাল। ছেলেমেয়েদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। হাল্লো! জনি, ওরা কারা?
আমার বন্ধু, মিস্টার ডাউসন। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এ-হলো জর্জিনা পারকার, বিখ্যাত বিজ্ঞানী মিস্টার জোনাথন পারকারের মেয়ে। ও কিশোর পাশা, বাংলাদেশী। ওর চাছা রকি বীচের বিরাট এক স্যালভিজ ইয়ার্ডের মালিক। ওর নাম মুসা আমান, আফ্রিকান অরিজিন, এখন রকি বীচে থাকে। বাবা উঁচুদরের সিনেমা টেকনিশিয়ান। আর এ-হলোগে রবিন মিলফোর্ড, আইরিশ, বাবা বড় সাংবাদিক। আর এই মিয়া হলো আমাদের রাফিয়ান, ওরফে রাফি, জিনার প্রিয় কুকুর।
হ্যাঁ। বোঝা যাচ্ছে, আমাদেরও প্রিয় হয়ে উঠবে, মাথা নেড়ে এগিয়ে এলেন মিস্টার ডাউসন। কাঁধের ওপর তুলে রেখেছেন লাঠিতে বাঁধা প্রজাপতির জাল। চশমার কাঁচের ওপাশে চোখ দুটো উজ্জ্বল। তিন কিশোর, এক কিশোরী। চমৎকার। তা বাপুরা নোংরা করে দিয়ে যাবে না তো এলাকাটাকে? দাবানল লাগিয়ে দেবে না তো?
কল্পনাই করতে পারি না ওকথা, হেসে বললো জিনা। মিস্টার ডাউসন, আপনার প্রজাপতির খামারটা দেখাতে নিয়ে যাবেন আমাদের? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
নিশ্চয়ই নেবো, আরও উজ্জ্বল হলো ডাউসনের চোখ। দেখানোর সুযোগই পাই না কাউকে। এদিকে বড় একটা আসে না কেউ। এসো, এদিক দিয়ে।
৩
সরু একটা পাহাড়ী পথ ধরে ওদেরকে নিয়ে চললেন ডাউসন। এতো জঙ্গল হয়ে আছে, পথটা প্রায় চোখেই পড়ে না। মাঝামাঝি আসতেই শোনা গেল একটা ভেড়ার বাচ্চার ডাক, পরক্ষণেই কথা বলে উঠলো একটা কচিকণ্ঠ, ভাইয়া, ভাইয়া, আমি এখানে। আমাকে নিয়ে যাবি?