অবশেষে তুলে আনা হলো রিড়কে। দড়ি বেয়ে উঠতে মুসা আর কিশোরের খুব একটা অসুবিধে হলো না, কারণ জনি আর জ্যাক তো রয়েছেই সাহায্য করার জন্যে।
খুব মজার একটা ব্যাপার ঘটে গেছে ভেবে আর চুপ থাকা সমীচীন মনে করলো না রাফি। ঘাউ ঘাউ করে হাঁক ছাড়লো কয়েক বার, বদ্ধ জায়গায় কানে তালা লাগিয়ে দিলো সকলের। ভয় পেয়ে ডেকে উঠলো ভেড়ার বাচ্চাটা, জিনার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগলো।
হউফ! করে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো জ্যাক। আর কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবো ভাবিনি! বাপরে, কি জায়গা দম বন্ধ করে দেয়! চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও না। বেরোই। আলোবাতাস দরকার। পানির অভাবে বুকটা শুকিয়ে যা খাঁ করছে। হারামজাদাগুলো সেই যে ফেলে চলে গেল, আর এলো না!
আবার পথ দেখিয়ে দলটাকে গুহার বাইরে বের করে নিয়ে এলো রাফিয়ান। স্বচ্ছন্দে। এবার আর মাটি কিংবা বাতাস শোকারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ভুল করেনি একটিবারের জন্যেও। ভেড়ার বাচ্চাটা কিভাবে নিরাপদে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এখন বোঝা গেল। অনুভূতি ওটারও যথেষ্ট প্রখর। ইন্দ্রিয়ের এই প্রখরতা কেবল মানুষেরই নেই।
উজ্জ্বল সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে চোখ ধাধিয়ে গেল ওদের। বিশেষ করে রিড আর জ্যাকের। দীর্ঘ সময় গাঢ় অন্ধকারে বন্দী ছিলো ওরা। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো দুজনেই।
এখানে কিছুক্ষণ বসে আগে চোখের আলো সইয়ে নিন, কিশোর পরামর্শ দিলো, নইলে হাঁটতে পারবেন না। তারপর আমাদের বলুন, ভেড়ার বাচ্চাটার গায়ে মেসেজ লিখলেন কিভাবে? ওটাও কি গর্তে পড়ে গিয়েছিলো?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো জ্যাক। আমাদের গর্তে ফেলে দিয়ে লোকগুলো চলে গেল। আমরা পড়েই আছি, পড়েই আছি। দিনরাত্রির প্রভেদ বোঝার উপায় নেই। সময় কতো, কি বার, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো শব্দও নেই। তারপর হঠাৎ করেই কানে এলো মুদ খটখট আওয়াজ। কিসের, বুঝতে পারলাম না। তখনও জানি না পাথরে লেগে ভেড়ার বাচ্চাটার খুরের শব্দ হচ্ছিলো। অবাক হলাম। আমাদের আরও অবাক করে দিয়ে গর্তে পড়লো বাচ্চাটা। একেবারে আমার ওপরেই। পড়েই চেঁচাতে শুরু করলো গলা ফাটিয়ে। বের করে দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। বুদ্ধিটা এলো মাথায়। মনে করলাম, বাইরে বেরোলে লোকের চোখে পড়বেই। যদিও বুঝতে পারছিলাম না কি করে ঢুকলো ওটা, আবার ঠিকমতো বাইরে বেরোতে পারবে কিনা এসব।
লিখে দিয়েছিলেন বটে, মুসা বললো, কিন্তু আরেকটু হলেই নষ্ট হয়ে যেতো আপনার মেসেজ। প্রায় মুছেই গিয়েছিলো।
তবু, শেষ পর্যন্ত বুঝতে তো পেরেছে, জোরে নিঃশ্বাস ফেললো জ্যাক। রিড হাত পা ছড়িয়ে চুপ করে বসে আছে, চোখ বন্ধ। তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার বললো সে, সুড়ঙ্গে ঢোকানোর পর পরই আমাদের সমস্ত জিনিস কেড়ে নিয়েছে ডাকাতগুলো। ঘড়ি, টাকাপয়সা, এমনকি কলমটা পর্যন্ত।
তাহলে লিখলেন কি দিয়ে? জিনা জিজ্ঞেস করলো।
রিডের প্যান্টের পকেটে একটুকরো কালো চক ছিলো, জ্যাক জানালো। ওই চক আমাদের কাছে থাকে। চিহ্ন দেয়ার জন্যে ব্যবহার করি আমরা। বিশেষ করে বড় বড় ম্যাপে এয়াররুটগুলোর ওপর। বাচ্চাটাকে ধরে রাখলো রিড, আমি ওটার পিঠে লিখলাম। অন্ধকারে কি লিখছি, তা-ও বোঝার উপায় ছিলো না। পড়তে যে পেরেছো, এটাই আমাদের ভাগ্য। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গর্তের বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছি বাচ্চাটাকে। ভয় পেয়ে, কিংবা ব্যথা পেয়ে, যে কারণেই হোক, গলা ফাটিয়ে কয়েকবার চেঁচালো ওটা। তারপর দিলো দৌড়, যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে। কি কাণ্ড, বলো তো? যেন আমাদের মেসেজ নেয়ার জন্যেই এসেছিলো ওটা! দুনিয়াতে অনেক রহস্যময় ব্যাপারই ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আবার কাকতালীয় ব্যাপার বলতেও ইচ্ছে করে না!
হুঁ, মাথা দোলালো জনি। নইলে ল্যারিই বা ওটার জন্য পাগল হবে কেন? আর ওটারই বা ঘুরে বেড়ানোর এতো শখ হবে কেন? যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক চলে যায়। আর গেলেই ওটার পিছে পিছে ছোটে ল্যারি। এজন্যে সবাই মিলে কতো বকাবকি করি দুজনকে। অথচ আজ এটার এই বাড়িপালানো স্বভাবের কারণেই খুঁজে পাওয়া গেল তোমাদেরকে! নইলে কোনোদিনই ওই গর্ত থেকে…
আর বলিস না, বলিস না! তাড়াতাড়ি হাত নাড়লো জ্যাক। দম বন্ধ হয়ে আসছে!…আচ্ছা, এবার বল দেখি, আমরা গায়েব হয়ে যাওয়ায় এয়ারফীল্ডে শোরগোল ওঠেনি?
উঠেছে, রবিন বললো। আপনাদের দুজনের প্লেন দুটো যে চুরি হয়েছে জানেন? যে দুটো আপনারা চালাতেন?
আন্দাজ করেছি। ওরাও আমাদেরকে ধরে নিয়ে এলো, ওদিকে প্লেনও উড়লো দুটো।…একটা কুকুরের চিত্তার কানে আসছিলো, পাহাড়ের ওপর থেকে। বুঝতে পেরেছি, রাফিয়ান। ইস, যদি তোরা তখন বুঝতে পারতি আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাহলে ছুটে আসতে পারতি।
হ্যাঁ, ঝড়ের রাতে অনেক ঘেউ ঘেউ করেছে রাফি, জিনা বললো। আমি ওকে ধমক দিয়ে থামিয়েছি। যদি বুঝতে পারতাম ডাকাতদের দেখে চিৎকার করেছে ও…যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর ওসব বলে লাভ নেই।
প্লেনগুলোর কি হয়েছে, জানো কিছু?
শুনেছি, ঝড়ের মধ্যে উড়তে গিয়ে সাগরে ভেঙে পড়েছে। পাইলটদের পাওয়া যায়নি, জনি জানালো।
ও, বিষণ্ণ হয়ে গেল জ্যাক। আমার খুব প্রিয় ছিলো প্লেনটা! আর ওড়াতে পারবো না! রিড, তোমারও নিশ্চয় খারাপ লাগছে?