ঢুকে পড়লো সবাই। প্রত্যেকের হাতেই টর্চ জ্বলছে।
আমিও ভেবেছিলাম…, বলেই থেমে গেল জিনা। তার কথার প্রতিধ্বনি উঠলো সুড়ঙ্গের দেয়ালে বাড়ি খেয়েঃ আমিও ভেবেছিলাম, আমিও ভেবেছিলাম… ভেবেছিলাম…ছিলাম… ছিলাম…ইলাম…
সেদিনকার চিৎকারের মানে এখন বুঝতে পারছি, প্রতিধ্বনির ভয়ে কণ্ঠস্বর একেবারে খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। ডাকাতগুলো চিৎকার করেছে, জোরে জোরে শিস দিয়েছে। সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওই শব্দ হয়ে উঠেছিলো ভয়ঙ্কর। আমার বিশ্বাস রাফির ঘেউ ঘেউ ওরা শুনতে পেয়েছিলো। ঘাবড়ে গিয়েছিলো মানুষ আসছে ভেবে। কাজেই ভয় দেখিয়ে আমাদেরকে তাড়ানোর জন্যে ওরকম শব্দ করেছিলো।
আর সত্যি… বলেই প্রতিধ্বনি শুনে গলার স্বর নামিয়ে ফেললো রবিন, আমরা ভয় পেয়ে পালিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছে, ওই শয়তানগুলো ওরকম আওয়াজ করেছিলো। এছাড়া ওরকম অদ্ভুত আওয়াজের আর কোনো ব্যাখ্যা নেই।… আরিব্বাবারে, কি লম্বা সুড়ঙ্গ! আর কি রকম এঁকেবেঁকে ঘুরে ঘুরে গেছে!…আরে, সামনে দেখি আবার দুই মুখ! কোনটা দিয়ে যাবো?
সেটা রাফিই বলে দেবে, জিনা বললো। একটা সুড়ঙ্গের মুখের কাছের মাটি ইতিমধ্যেই শুকতে আরম্ভ করেছে রাফি, এবারও বাঁয়েরটা।
দড়ি আনার দরকারই ছিলো না, জনি বললো। রাফি যেভাবে পথ চিনে এগোচ্ছে, আমাদের অসুবিধে হতো না। ঠিক বের করে নিয়ে আসতো।
যা, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দড়ির চেয়ে অনেক ভালো পথপ্রদর্শক সে। তবে ও না থাকলে দড়ি অবশ্যই ব্যবহার করতে হতো। নইলে এই সুড়ঙ্গ আর গুহার গোলকধাঁধা থেকে বেরোনো মুশকিল হয়ে যেতো। মনে হয় পাহাড়ের একেবারে পেটের মধ্যে চলে এসেছি…।
এই সময় হঠাৎ থেমে গেল রাফি। মাথা তুলে পাশে কাত করে কান পেতে শুনছে। জ্যাক আর রিডের সন্ধান কি পেয়ে গেল? ঘেউ ঘেউ করে উঠলো একবার। বদ্ধ জায়গায় বিকট হয়ে কানে বাজলো সেই ডাক।
কাছেই কোনোখান থেকে শোনা গেল তার ডাকের জবাবঃ এইই। এইই! এই যে! এখানে! এখানে!
জ্যাক ভাইয়া! প্রতিধ্বনির কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো জনি। আনন্দে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যেই লাফাতে শুরু করলো। জ্যাক ভাইয়া, শুনছো! আমিইইই, আমি জনিইই!
সাথে সাথে সাড়া এলো, জনি, এই যে এদিকে! বুঝতে পারছিস?
প্রায় ছুটে এগোলো রাফিয়ান। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লে হঠাৎ। আগে আগে চলেছে কিশোর, আরেকটু হলে তার গায়ের ওপরই পড়তো। প্রথমে বুঝতে পারলো না কি ব্যাপার। তারপর টর্চের আলোয় স্পষ্ট হলো নিরেট দেয়াল, ওদের পথ আগলে যেন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে টোগো। অবাক কাণ্ড। সামনে দেয়াল, অথচ জ্যাকের কণ্ঠ কানে আসছে!
এই যে, আমরা এখানে!
বোঝা গেল, কিভাবে আসছে। রাফিয়ান যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার পাশেই মেঝেতে একটা ফোকর। কিশোরের টর্চের আলো পড়লো তার ওপর। বললো, ওই যে, ওখানেই আছে! ওই গর্তে! জ্যাকডাই, ওখানেই আছেন, না? জবাব দিন!
জবাব এলো।
আরেকটু সামনে এগিয়ে গর্তের ভেতর আলো ফেললো কিশোর। ওই তো, গুহার মেঝেতে পড়ে রয়েছে একজন মানুষ। পাশে দাঁড়িয়ে আরেকজন, জ্যাক ম্যানর। শুয়ে থাকা লোকটাই তাহলে রিড।
ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের খুঁজে পেয়েছে তোমরা, জ্যাক বললো। ওরা আমাদেরকে এখানে রেখে চলে গেল, আর এলো না। হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছে এই গর্তে। রিডের গোড়ালি মচকে গেছে। আমি ভালোই আছি, কিন্তু উঠবো কিভাবে? অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। কারও সাহায্য ছাড়া পিরবোও না।
আর কোনো অসুবিধে নেই, জ্যাক ভাইয়া, আমরা এসে গেছি, কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে গর্তের ভেতরে উঁকি দিয়ে বললো জনি। কিভাবে তুললে সুবিধা হবে? গর্তের মুখটা তো বেশি বড় না।
প্রথমে আমাকে টেনে তোলো, জ্যাক বললো। তারপর দুজন গর্তে নেমে রিডকে তুলে ধরবে, তখন তাকে আমি টেনে তুলে নিতে পারবো। এমন বাজে জায়গা আর দেখিনি। ওই গর্তটা ছাড়া বেরোনোর আর কোনো জায়গাই নেই। কতো লাফালাফি যে করলাম। ছুঁতেই পারলাম না ওপরের ধার! আর রিড তো দাঁড়াতেই পারে না।
শুধু কিশোর আর জনিকে দিয়ে হলো না। মুসাকেও হাত লাগাতে হলো। তারপর অনেক কায়দা কসরৎ করে টেনে তোলা হলো জ্যাককে। সাথে দড়ি না আনলে বের করতে পারতো না। জিনা আর রবিনও হাত গুটিয়ে বসে নেই। টোগোকে আটকে রেখেছে জিনা, ওটা কেবলই ছুটে একদিকে চলে যেতে চায়। আর রবিন দুই হাতে দুটো টর্চ উচিয়ে রেখেছে।
অবশেষে উঠে এলো জ্যাক। দড়ি ধরে নেমে গেল কিশোর আর মুসা। ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন রিড। ঘোলাটে দৃষ্টি। জ্যাকের ধারণা, মাথায় আঘাত পেয়েছে রিড। দুদিক থেকে ধরে তাকে তুলে দাঁড় করালো কিশোর আর মুসা। এক পা বাকা করে বেকায়দা ভঙ্গিতে দাঁড়ালো সে, মুসার কাঁধে ভর রেখে। বের করা শক্ত।
তবে বেশি ভারি না রিড, এই যা সুবিধে। দুই হাতে ধরে তাকে মাথার ওপর তুলে ধরলো মুসা, অনেকটা টারজানের মতো। সুড়ঙ্গের মেঝেতে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো জ্যাক। মেঝে ঢালু, তাই মাথা পায়ের চেয়ে নিচুতে। পিছলে আবার গর্তে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। কিন্তু পরোয়া করলো না সে। পেছনে একই ভাবে শুয়ে পড়ে শক্ত করে তার পা জড়িয়ে ধরে রইলো জনি।, বুক পর্যন্ত গর্তের কিনারে বাড়িয়ে দিয়ে স্কুলে পড়লো জ্যাক। হাত বাড়ালো নিচের দিকে। রিডের হাতের নাগাল পেয়ে শক্ত করে ধরলো। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে টেনে তুলতে লাগলো। নিচ থেকে ঠেলে রেখেছে কিশোর আর মুসা।