উপায় আছে, কিশোর বললো, দিনের বেলায় দেখেছি। পলকের জন্যে টর্চ জ্বেলেই নিভিয়ে ফেললো সে, যাতে কাছেই ছাউনির বেড়ায় ঠেস দিয়ে রাখা মইটা ওরা দেখতে পারে।
যা, দেখা যাবে, মুসা বললো। তবে খুব আস্তে আস্তে আনতে হবে ওটা। শব্দ করা চলবে না। মই লেগে সামান্য ঘষার আওয়াজ হলেও ওঘরে যে আছে, উঁকি দিয়ে দেখতে আসবে।
তিনজনে মিলে বয়ে আনবো, শব্দ হবে কেন? জানালাটা বেশি ওপরে না, মইটাও লম্বা না যে বেশি ভারি হবে।
সত্যি বেশি ভারি না মইটা। বয়ে এনে আস্তে করে কটেজের দেয়ালে ঠেকাতে কোনো অসুবিধেই হলো না ওদের। শব্দ হলো না।
আমি আগে উঠি, কিশোর বললো। মইটা শক্ত করে ধরে রাখো। আর আশেপাশে নজর রাখবে। কারও সাড়া পেলে কিংবা কাউকে আসতে দেখলে সতর্ক করে দেবে আমাকে। মইয়ের ওপর আটকে থেকে বিপদে পড়তে চাই না।
দুদিক থেকে মইটাকে শক্ত করে ধরে রাখলো জনি আর মুসা। বেয়ে ওপরে উঠলো কিশোর। জানালার চৌকাঠের কাছে পৌঁছে সাবধানে মাথা তুললো।
এই ঘরেও মাত্র একটা মোম জ্বলছে। খুব ছোট ঘর। আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। অগোছালো। বিছানায় বসে আছে একজন বিশালদেহী মানুষ। চওড়া কাধ, ভীষণ মোটা বাড়।
লোকটার দিকে একনজর তাকিয়েই নিশ্চিত হয়ে গেল কিশোর, হ্যাঁ, এই লোক মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেই পারে। ভয়ানক নিষ্ঠুর চেহারা। মনে পড়লো বৃদ্ধার কথাঃ আমাকে মারে সে! হাত মুচড়ে দেয়! খুব খারাপ লোক!
মোমের কাছে ধরে একটা খবরের কাগজ পড়ছে লোকটা।
কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে সময় দেখলো। বিড়বিড় করে কি বললো, বোঝা গেল না। তারপর উঠে দাঁড়ালো লোকটা। ভয় পেয়ে গেল কিশোর, জানালার কাছে চলে আসবে না তো সে? আর এখানে থাকা যায় না। শব্দ না করে যতো তাড়াতাড়ি পারলো নেমে এলো মই বেয়ে।
মিসেস ডেনভারের ছেলে, বন্ধুদেরকে জানালো সে। ও জানালার কাছে আসবে এই ভয়ে তাড়াহুড়ো করে নেমেছি। জনি, তুমি গিয়ে একবার দেখে এসো। তাহলে পুরোপুরি শিওর হওয়া যাবে যে ওই লোকটাই টেড ডেনভার।
মই বেয়ে উঠে গেল জনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এলো আবার। হ্যাঁ, টেডই। আশ্চর্য! এতোখানি বদলে গেল! শয়তানের মতো লাগছে আজ। অথচ কয়েক দিন আগেও এতোটা খারাপ লাগেনি। মা সন্দেহ করতো, খারাপ লোকের সঙ্গে ওঠাবসা আছে তার। অনেক বেশি মদ খায়। ওই করে করেই এরকম চেহারা হয়েছে।
এমনভাবে ঘড়ি দেখলো, কিশোর বললো, যেন কারো আসার অপেক্ষা করছে। আমাদেরকে যে টাকা দিলো, কাল রাতে পাহাড়ে গেল, সেই চশমা পরা লোকটার জন্যে নয় তো? নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলব আছে ব্যাটাদের। নইলে মিথ্যে কথা বলবে কেন?
এসো, জনি বললো, কোথাও লুকিয়ে থাকি। দেখবো, কি করে?
হ্যাঁ। ওই গোলাঘটায় চলো।
নিঃশব্দে ভাঙা বাড়িটার কাছে চলে এলো ওরা। ছাতের অনেকখানি নেই। দেয়ালও বেশির ভাগই ধসে পড়েছে। পুরোপুরি ধসে পড়ার অপেক্ষাতেই যেন এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধুকছে ভাঙা বাড়িটা। ভাপসা গন্ধ। নোংরা। বসার কোনো পরিষ্কার জায়গাই নেই। আশাও করেনি কিশোর। ধুলো লেগে থাকা কয়েকটা পুরানো বস্তা এককোণে টেনে নিয়ে গিয়ে বসে পড়লো তার ওপরেই।
খাইছে! কি গন্ধরে বাবা! নাক সিঁটকালো মুসা। আলু পচেছে। এখানে বসা যাবে না। চলো, আর কোথাও যাই।
শশশ! হুঁশিয়ার করলো কিশোর। একটা শব্দ শুনলাম!
চুপ করে বসে কান পাতলো ওরা। শব্দটা তিনজনেই শুনতে পাচ্ছে। খুব হালকা পায়ে এগিয়ে আসছে কেউ। পায়ে রবার সোলের জুতো, সেজন্যেই বেশি শব্দ হচ্ছে না। চলে গেল গোলাঘরের পাশ দিয়ে। তারপর শোনা গেল মৃদু শিস।
উঠে দাঁড়িয়ে ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি দিলো কিশোর। দুজন লোক, জানালো সে। টেডের জানালার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের জন্যেই নিশ্চয় অপেক্ষা করছিলো টেড। ওই যে, টেড নামছে মনে হয়। এখানে না আবার কথা বলতে চলে আসে!
সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু আর সময় নেই। কটেজের সামনের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। বেরিয়ে এলো টেড। এখনও তাকিয়েই রয়েছে কিশোর। সামনের জানালা দিয়ে মিস্টার ডাউসনের ঘর থেকে এসে পড়া স্নান আলোয় আবছামতো দেখতে পাচ্ছে লোকগুলোকে।
গোলাঘরের দিকে এলো না ওরা। কটেজের কোণ ঘুরে নিঃশব্দে চলে গেল তিনজনেই।
এসো, জরুরী গলায় বললো কিশোর, পিছু নেবো। ব্যাটাদের কথা শুনতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে কি করছে।
কটা বাজে? মুসা বললো। আমাদের দেরি দেখলে রবিনরা না আবার চিন্তা করে।
বারোটা বেজে গেছে, স্যুমিনাস ডায়াল ঘড়ি দেখে বললো কিশোর। ওরা বুঝবে, জরুরী কোনো কাজে জড়িয়ে গেছি আমরা।
পা টিপে টিপে কটেজের অন্যপাশে বেরিয়ে এলো ওরা। লোকগুলোকে দেখা গেল কাঁচের ঘরের ওপাশে কয়েকটা গাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কথা বলছে, কিন্তু এতো নিচু গলায়, কিছু বোঝা যায় না এখান থেকে।
তারপর গলা চড়ালো একজন লোক। জনি চিনতে পারলো, টেড ডেনভার। কোনো কারণে রেগে গেছে। খুব বদমেজাজী। যদি বোঝে তাকে ঠকানোর চেষ্টা হচ্ছে, তাহলে আর এক মুহূর্ত শান্ত থাকতে পারে না।
অন্য দুজন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। চিৎকার করে বললো টেড, আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি আমার টাকা চাই। তোমরা যা যা করতে বলেছে, তাই করেছি। তোমাদের সাহায্য করেছি, এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছি। কাজ শেষ হয়ে গেছে, এখন আমার টাকা দাও।