সে করা যাবে, যাও না আগে তোমরা, জিনা বললো। রাফিকে নিয়েই যাও, বুঝেছো? ওই ডাইনী বুড়িটা কি করে বসে ঠিক নেই! তার ওপর রয়েছে কালো চশমাওয়ালা লোকটা। পাজি লোক।
তোমরা এই পাহাড়ে একা থাকবে, রাফিকে তোমাদেরই বেশি দরকার। আমাদের কিছু হবে না। বারোটার মধ্যেই ফিরে আসবো।
খোলা আকাশের নিচে বসে কথা বলছে ওরা। আজ আর মেঘ নেই, ফলে ভাবতে ঢোকারও দরকার নেই। ঝকঝকে তারাজলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন কল্পনাই করা যায় না, গত রাতে এই সময় কি প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি ছিলো।
ঘড়ি দেখলো কিশোর। যাবার সময় হয়েছে। মুসা, ওঠো।
রবিন আর জিনাকে সাবধানে থাকতে বলে রওনা হলো দুজনে। আকাশ পরিষ্কার বটে, কিন্তু অন্ধকার যথেষ্ট আছে। খোলা অঞ্চলে এমনিতেই অন্ধকার কিছুটা কম লাগে, কিন্তু তারপরেও যা আছে, অনেক।
তবু সাবধানে থাকতে হবে আমাদের, নিচু গলায় বললো কিশোর। কেউ যাতে দেখে না ফেলে।
সোজা চলে এলো ওরা খামারের পেছনের বড় ওক গাছটার কাছে। জনি নেই। তবে মিনিট দুয়েক পরেই খসখস শব্দ শোনা গেল। জনি এলো। হাঁপানো দেখেই অনুমান করা গেল ছুটে এসেছে।
সরি, দেরি হয়ে গেল, ফিসফিস করে বললো সে। ছটার খবর শুনেছো?
শুনেছি, জবাব দিলো কিশোর। খুব খারাপ লেগেছে আমাদের।
আমাদের লাগেনি, জনি বললো। আমি জানি, জ্যাক ভাইয়া আর রিড ওগুলোতে ছিলো না। যদি মরেই থাকে, দুটো চোর মরেছে। চোরের জন্যে দুঃখ করতে যাব কেন?
না, কোনো কারণ নেই, কিশোর বললো। মনে মনে অবশ্য সে জনির মতো নিশ্চিত হতে পারলো না যে বিমান দুটোতে ওই দুইজন ছিলো না।
তা এখন কি করবে, ভেবেছো কিছু? জনি জিজ্ঞেস করলো। কটেজের জানালায় আলো দেখছি, পর্দা টানেনি বোঝাই যায়। গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পারি ভেতরে কি হচ্ছে।
তা-ই করবো। এসো। সাবধান, একটু শব্দও যেন না হয়। আমার পেছনে, একসারিতে এসো।
পা টিপে টিপে কটেজের দিকে এগিয়ে চললো ওরা।
১২
নিঃশব্দে কটেজের কাছে চলে এলো তিনজনে।
জানালার বেশি কাছে যাবে না, সতর্ক করলো কিশোর, ফিসফিস করে কথা বলছে। যতোটা না গেলে নয় ঠিক ততোটা। আমরা দেখবো, কিন্তু আমাদের যেন দেখে না ফেলে।
ওটা বোধহয় রান্নাঘরের জানালা, মুসা বললো। মিসেস ডেনভার হয়তো ওখানেই থাকে। ঘুমিয়েছে কিনা কে জানে!
জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো ওরা। পর্দা নেই। একটা মাত্র মোম জ্বলছে ঘরে। আলোর চেয়ে ছায়াই বেশি।
ঘুমায়নি মিসেস ডেনভার। বাদামী রঙের একটা রকিং চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে দুলছে সামনে পেছনে। পরনে ময়লা ড্রেসিং গাউন। মুখ দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট, তবু কিশোরের মনে হলো, ভয় পাচ্ছে মহিলা। কোনো কারণে অস্বস্তিতে ভুগছে। বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথাটা। মাঝে মাঝে কাঁপা হাতে সরিয়ে দিচ্ছে মুখের ওপর এসে পড়া ধোঁয়াটে চুল।
না, ডাইনী নয়! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। এখন শিওর হলাম। ডাইনী হলে ওভাবে ভয় পেতো না। এখন বসে বসে তপজপ করতো। আসলে ও অতি সাধারণ এক বৃদ্ধা।
এত রাত পর্যন্ত জেগে রয়েছে কেন? নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলো কিশোর। কারো অপেক্ষা করছে নিশ্চয়।
আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে, জনি বললো। আরও হুঁশিয়ার থাকতে হবে আমাদের। বলে চট করে একবার পেছনে তাকিয়ে নিলো সে, পেছন থেকে এসে ঘাড়ের ওপর কেউ পড়ছে কিনা দেখলো।
চলো, ঘুরে বাড়ির সামনের দিকে চলে যাই, মুসা বললো।
সামনের দিকেও একটা আলোকিত জানালা দেখা গেল। রান্নাঘরের চেয়ে অনেক বেশি আলো এখানে। কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে কাঁচের শার্সির কাছ থেকে দূরে রইলো ওরা। টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল দুজন লোককে, একগাদা কাগজ ঘাটাঘাটি করছে।
মিস্টার ডাউসন, নিচু গলায় বললো কিশোর। অন্য লোকটা নিশ্চয় তাঁর বন্ধু ডরি। চোখে চশমা তো সত্যিই নেই। এই লোকের সঙ্গে দেখা হয়নি আমাদের, টাকাও এই লোক দেয়নি। যে দিয়েছিলো তার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিনজনে। অতি সাধারণ চেহারা, আর দশজনের মাঝখান থেকে আলাদা করে চেনা যাবে না। ছোট গোঁফ, কালো চুল, বড় নাক।
কি করছে? জনির প্রশ্ন।
কোনো কিছু লিস্ট করছে, কিশোর বললো। বোধহয় কাস্টোমারদের। বিলটিল বানাবে আরকি। মিস্টার ডাউসন ঠিকই বলেছিলেন, আমাদেরকে যে টাকা দিয়েছে সে ডরি নয়। তারমানে কাল রাতে পাহাড়ে জাল হাতে এই লোককে দেখিনি।
তাহলে সে কে? বলে জানালার কাছ থেকে টেনে দুজনকে সরিয়ে আনলো মুসা, সহজভাবে কথা বলার জন্যে। আর কেনই বা জাল হাতে পাহাড়ে গেল সে? মথ শিকারের মিথ্যে গল্প শোনালো? আর যে রাতে প্লেনগুলো চুরি গেল, ঠিক সেই রাতেই কেন?
ঠিক, কেন? মুসার সুরে সুর মেলালো জনি। আরও আস্তে কথা বলার জন্যে তাকে কনুইয়ের গুতো লাগালো কিশোর। কাল রাতে নিশ্চয় রহস্যময় কিছু ঘটেছিলো পাহাড়ে, আস্তেই বললো সে। এমন কিছু, যে ব্যাপারে লোকে কিছুই জানে না। কিশোর, তোমরা তো গোয়েন্দা। ধরো না ওই লোকটাকে, যে নিজেকে ডরি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। খুঁজে বের করো তাকে। জিজ্ঞেস করো এসবের মানে কি?
করবো, কথা দিলো কিশোর। এখন দেখি, আর কোনো জানালায় আলো আছে কিনা?…আছে, ওই যে একটায়। ছাতের ঠিক নিচে। কে থাকে ওখানে?
হয়তো বুড়ির ছেলে, আন্দাজ করলো মুসা। থাকতেও পারে, জনি বললো। কিন্তু দেখবো কিভাবে?