প্রতিধ্বনি তুললো সেই ডাক, বিকট হয়ে এসে কানে বাজলো।
রাফির নিজেরই পছন্দ হলো না সেই শব্দ। চিৎকার থামিয়ে জিনার গা ঘেঁষে এলো। হাহ হাহ করে হাসলো জিনা। দূর, বোকা, এটা তো গুহা। জীবনে কম গুহা দেখেছিস, ভয় পাচ্ছিস যে এখন?…এই, সাংঘাতিক ঠাণ্ডা তো এখানে! ভাগ্যিস অ্যানারাক এনেছিলাম।
গোটা দুই ছোট আর সাধারণ গুহা পেরিয়ে বড় একটা গুহায় ঢুকলো ওরা। যেখানে সেখানে বরফ চমকাচ্ছে। কিছু ঝুলে রয়েছে হাত থেকে, কিছু উঠে গেছে মেঝে থেকে। ওপরের বরফের সঙ্গে নিচের কোনো কোনোটা মিলে গিয়ে তৈরি হয়েছে থাম, দেখে মনে হয় এখন গুহার ছাতের ভার রক্ষা করছে ওগুলো।
দারুণ। বিড়বিড় করলো রবিন। দেখার মতো জিনিস!
সুন্দর, কিন্তু কেমন যেন গা ছমছমে, কিশোর বললো। বলতে পারবো না কেন। এসো, পরের ওহাটা দেখি।
পরেরটা আবার ছোট। তবে বরফ আছে। টর্চের আলো ঠিকরে পড়ছে ওগুলোতে। সৃষ্টি করছে রামধনুর সাত রঙ। আরিব্বাবা! চোখ বড় বড় করে ফেললো জিনা। একেবারে পরীর রাজ্য!
পরের গুহাটায় কোনো রঙ নেই। দেয়াল, মেঝে, ছাত, থাম সবকিছু একধরনের ফ্যাকাসে সাদা, টর্চের আলো ঠিকরে এসে চোখে লাগে। আসলে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট এতো বেশি লেগে গেছে এখানে, থাম এত ঘন, মাঝের ফাঁক দিয়ে অন্যপাশ দেখাই কঠিন।
মোট তিনটে সুড়ঙ্গমুখ দেখা গেল এই গুহাটায়। একটাতে দড়ি আছে, দুটোতে নেই। যে দুটোতে নেই, ওগুলোর মুখের কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলো অভিযাত্রীরা। ভেতরটা অন্ধকার, নিস্তব্ধ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে গায়ে কাঁটা দিলো ওদের। যদি ঢুকে পথ হারায়, আর কোনোদিন বেরোতে পারবে কিনা সন্দেহ!
দড়িওয়ালাটা দিয়েই ঢোকা যাক, জিনা প্রস্তাব দিলো। ওমাথায় কি আছে দেখে ফিরে আসবো। কি আর থাকবে, হয়তো আরও কিছু গুহা।
দড়ি ছাড়া একটা গুহামুখের ভেতরে ঢুকে ঝুঁকতে আরম্ভ করলো রাফিয়ান। তাড়াতাড়ি ডাক দিলো তাকে জিনা, এই, জলদি বেরিয়ে আয়! হারিয়ে যাবি?
কিন্তু ফিরলো না রাফি, ঢুকে গেল আরও ভেতরে। ঘন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হলো সবাই।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কি দেখে গেল ওখানে? রাফি, এইই রাফি! বিকট প্রতিধ্বনি উঠলো গুহার দেয়ালে দেয়ালে।
ঘেউ ঘেউ করে সাড়া দিলো রাফি। মনে হলো, মুহূর্তে ওই ডাকে ভরে গেল সমস্ত গুহা আর সুড়ঙ্গ। বিচিত্র আওয়াজ! সহ্য করতে না পেরে কানে আঙুল দিলো রবিন।
ঘাউ! ঘাউ! ঘাউ! ঘাউ। ডেকেই চলেছে যেন একাধিক কুকুর। অথচ রাফি ডেকেছে মাত্র দুবার। ছুটে বেরিয়ে এলো সে। সাংঘাতিক অবাক হয়েছে। বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন এই শব্দের স্রষ্টা সে নিজে।
গলায় শেকল পরিয়ে আনা উচিত ছিলো তোকে, বকা দিলো জিনা। খবরদার, আর কাছ থেকে সরবি না।
কথা শুনলো এবার রাফি। কাছে কাছেই রইলো। গুহা থেকে গুহায়, সুড়ঙ্গ থেকে সুড়ঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলো দলটা। দড়ি লাগানো জায়গাগুলোতেই শুধু ঘুরছে ওরা। অনেক সুড়ঙ্গ দেখলো, যেগুলোতে দড়ি নেই। ভেতরে কি আছে। দেখার লোভও হলো, কিন্তু জোর করে দমন করলো কৌতূহল। অযথা বিপদে পড়ার কোনো মানে হয় না।
একটা গুহায় একটা ডোবামতো দেখা গেল। পানি জমে বরফ হয়ে আছে। আয়নার কাজ করছে ওটা। ছাতের সব কিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে ওর ভেতর। ঠিক এই সময় একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এলো ওদের। চিনতে পারলো না কিসের শব্দ। সোজা হয়ে কান পাতলো সবাই।
কাঁপা কাঁপা, তীক্ষ্ণ শব্দটা যেন ক্রমান্বয়ে ভরে দিতে লাগলো সব গুহা, সুড়ঙ্গ। একবার বাড়ছে, আবার কমছে…বাড়ছে…কমছে…
বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলো না রাফি। ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠলো সে। যেন তার ডাকের জবাবেই আরও জোরে হলো আগের বিচিত্র শব্দটা।
এ-কি ভূতুড়ে কাণ্ড! ভয়ে ভয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে তাকিয়ে রইলো মুসা।
ব্যাপারটা কি! ফিসফিসিয়ে বললো জিনা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে। চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও না!
কানে আঙুল দিয়ে ছুটলো ওরা। দৌড়ে চললো প্রবেশপথের দিকে। যেন হাজারখানেক বুনো কুকুর একসঙ্গে তাড়া করেছে ওদেরকে।
৯
প্রবেশপথের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো দলটা। শব্দ শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে বলে এখন গাধা মনে হচ্ছে নিজেদের।
বাবারে বাবা! কপালের ঘাম মুছে বললো মুসা। মনে হচ্ছিলো কানের ফুটো দিয়ে একেবারে মগজে ঢুকে যাচ্ছে।
ভয়ানক শব্দ! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জিনার মুখ। ওই গুহায় আর ঢুকছি না আমি! চলো, ক্যাম্পে যাই।
খড়িমাটি বিছানো রাস্তা ধরে তাঁবুতে ফিরে চললো ওরা। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘও কাটতে শুরু করেছে।
ক্যাম্পে ফিরে একটা তাবুতে ঢুকে আলোচনায় বসলো ওরা।
ওরকম শব্দ প্রায়ই শোনা যায় কিনা, মুসা বললো, জিজ্ঞেস করতে হবে জনিকে। আশ্চর্য! দর্শকদের এভাবেই স্বাগত জানায় নাকি ওই গুহা!
সে যা-ই হোক, কিশোর বললো, বেশি ছেলেমানুষী করে ফেলেছি আমরা। রীতিমতো লজ্জা পাচ্ছে এখন সে।
এক কাজ করা যাক তাহলে, পরামর্শ দিলো জিনা, আবার ফিরে গিয়ে চিল্কারের জবাবে আমরাও চিৎকার শুরু করি। দেখবো কি হয়?
ওসব করে আর লাভ নেই, আরও বেশি ছেলেমানুষী করতে রাজি নয় কিশোর। চিৎকার-প্রতিযোগিতায় কিছু হবে না। কম্বলের তলা হাতড়ে ফীভগ্নাস বের করে গলায় ঝোলালো সে। এয়ারফীন্ডের অবস্থা দেখতে যাচ্ছি আমি।