ঝড়ের মাঝে ওড়ার ট্রেনিং দিচ্ছে? নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো যুক্তিটা। না, তা হতে পারে না।
এখান থেকে ওড়েনি, রবিন বললো। হয়তো অন্য কোনোখান থেকে এসেছে। কিংবা উড়ে যাচ্ছিলো এখান দিয়ে। আবহাওয়া বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ল্যান্ড করছে।
হ্যাঁ, তা হতে পারে, একমত হলো মুসা। আশ্রয় খুঁজছে।
মাথা নাড়লো কিশোর। না, আমার তা মনে হয় না। এয়াররুট থেকে অনেক দূরে এই এয়ারফীন্ড। তাছাড়া এটাকে ঠিক এয়ারপোর্টও বলা যায় না, অতি সাধারণ একটা এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন। আর যদি আবহাওয়া খারাপের কারণে নামতে বাধ্যই হয়, এখানে কেন? ধারেকাছেই প্রথম সারির বিমান বন্দর রয়েছে, ওখানে যাবে। আশ্রয়, সাহায্য সবই পাওয়া যাবে ওখানে।
তাহলে হয়তো মহড়াই দিচ্ছে, জিনা বললো। জনির ভাই। ঝড়ের মাঝে উড়ে হাত পাকিয়ে নিচ্ছে।
যা-ই হোক, এঞ্জিনের শব্দ হারিয়ে যেতেই ব্যাপারটা গুরুত্ব হারালো ওদের কাছে, আপাতত। হাই তুললো রবিন, শোয়া দরকার। ঘুম পাচ্ছে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ঘড়ি দেখলো। রবিন, রাফিকে নিয়ে তুমি আর জিনা এটাতেই থাকো। আমি আর মুসা চলে যাচ্ছি ওটাতে। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দরজার ফাঁক বন্ধ করে দেবে। কিছু দরকার হলে, কিংবা অসুবিধে হলে ডাকবে আমাদের।
আচ্ছা, মাথা কাত করলো রবিন।
বৃষ্টির মাঝে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল কিশোর আর মুসা। দরজার ফাঁকটা শক্ত করে আটকে দিয়ে এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো রবিন।
জিনাও হলো। তার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো রাফিয়ান। সারা রাতে একটা শব্দও করলো না আর।
পরদিন সকালেও মুখ গোমড়া করে রইলো আকাশ। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে মুসা বললো, আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনা উচিত ছিলো। আজও পরিষ্কার হবে কিনা সন্দেহ। কটা বাজে, কিশোর?
আটটা! আজকাল ঘুম খুব বেড়ে গেছে আমাদের। চলো দেখি, ওরা উঠলো কিনা। অ্যানারা পরে নাও, নইলে ভিজবে।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে তখনও। ঝর্না থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো ওরা। নাস্তা করতে বসলো। তাবুর মধ্যে গাদাগাদি করে খেতে ভালো লাগছে না। রোদ নেই, ফলে মনও বিষণ্ণ হয়ে যায়। ভাবছে, দিনটা যদি কিছু পরিষ্কার হতো, জনিদের ফার্মে অন্তত যাওয়া যেতো।
নাস্তার পরে মুসা বললো, যে-রকম অবস্থা, গুহায়ই বোধহয় ঢুকতে হবে আমাদের। বাইরে কোথাও যেতে পারবো না।
তা-ই চলো, জিনা বললো।
ম্যাপ দেখে নেয়া দরকার, পরামর্শ দিলো কিশোর। গুহার কোনো একটা মুখ নিচয় রাস্তা-টাস্তার কাছে বেরিয়েছে। পাহাড়ের গোড়ার দিকেই কোথাও হবে।
থাকলে থাক না থাকলে নেই,মুসা বললো, গেলেই দেখতে পাবো। আর না থাকলেই বা কি? আসল কথা, এখন বসে থাকতে ভাল্লাগছে না, একটু হাঁটাহাঁটি করতে চাই, ব্যস।
বাস, ঝোপঝাড়, সব ভেজা। ওগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতেই বিরক্ত লাগে। লাফিয়ে লাফিয়ে আগে আগে চলছে রাফিয়ান।
সবাই টর্চ নিয়েছে তো? মনে করিয়ে দিলো রবিন। গুহার ভেতরে কিন্তু দরকার হবে।
যা, রাফি ছাড়া সবাই নিয়েছে। তার অবশ্য দুটো প্রাকৃতিক টর্চই আছে, চোখ, গুহার অন্ধকারেও দেখতে পাবে। তাছাড়া রয়েছে প্রখর ঘ্রাণশক্তি আর শ্রবণশক্তি, মানুষের নাক-কানের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ওর যন্ত্রগুলো।
ঢাল বেয়ে কিছুক্ষণ নেমে উত্তরে মোড় নিলো ওরা। হঠাৎ করেই এসে পড়লো একটা চওড়া পথে, ঘাস আর আগাছা নেই ওখানে, কেটে সাফ করা।
দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। নিশ্চয় কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই পথ।
তাই তো মনে হচ্ছে, রবিন বললো। চকের খনিটনি আছে বোধহয়। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা খড়িমাটির ডেলায় লাথি মারলো সে।
চলো না এগিয়ে দেখি, বললো জিনা।
পথের একটা মোড় ঘুরতেই নোটিশ চোখে পড়লো। ওটার বাংলা করলে দাঁড়ায়ঃ গুহা এদিকে। দড়ি লাগানো পথগুলো ধরে গেলে ভালো। যেগুলোতে দড়ি নেই সেগুলোয় ঢুকলে পথ হারানোর ভয় আছে। সাবধান!
ভালোই তো মনে হচ্ছে, উত্তেজনা ফুটলো কিশোরের কণ্ঠে। জনিও বলেছিলো বটে, ওগুলোতে বিপদ আছে। চলো, ঢুকেই দেখা যাক।
হাজার হাজার বছরের পুরানো এগুলো, রবিন বললো। স্ট্যালামাইট আর স্ট্যালাকটাইট জমে থাকে এসব গুহায়।
শুনেছি, জিনা বললো, হাত থেকে নাকি ঝুলে থাকে জমাট বরফ। নিচে থেকেও বরফের স্তম্ভ উঠে যায় ওপর দিকে, ওপরেরগুলোকে ধরার জন্যে।
আমিও শুনেছি, মুসা বললো। নাকি ভূগোল বইয়ে পড়লাম, মনে নেই। ছাত থেকে যেগুলো নামে ওগুলোকে বলে স্ট্যালাকটাইট, আর মেঝে থেকে যেগুলো ওঠে ওগুলোকে স্ট্যালাগমাইট।
বইয়েই বোধহয় পড়েছি। হাত নাড়লো জিনা, কি জানি, কোনটাকে কি বলে।
গুহার কাছাকাছি এসে পথের চেহারা অন্যরকম হয়ে গেল। আলগা খড়িমাটি পড়ে নেই। রুক্ষও নয়, বেশ মসৃণ। প্রবেশপথটা মাত্র ছয় ফুট উচু, তার ওপরে একটা সাদা রঙ করা বোর্ডে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা রয়েছে মাত্র দুটো শব্দঃ বাটারফ্লাই কেভস।
রাস্তার মোড়ে যে হুঁশিয়ারিটা দেখেছিলো, সেরকমই আরেকটা নোটিশ দেখা গেল গুহা-মুখের ঠিক ভেতরে।
ওটার দিকে রাফিয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে জিনা বললো, পড়ে নে ভালোমতো। আমাদের কাছাকাছি থাকবি।
টর্চ জ্বেলে ঢুকে পড়লো ওরা। চারটে টর্চের আলোয় ঝলমল করে উঠলো চারপাশের দেয়াল। অবাক হয়ে চিৎকার শুরু করে দিলো রাফি। বদ্ধ গুহায়