পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে চললো রাফিয়ান। কিছুদূর এগিয়ে তিনটে টর্চের আলো চোখে পড়লো কিশোরের। তার দেরি দেখে বেরিয়ে পড়েছে রবিন, মুসা আর জিনা।
কিশোওর, তুমি? শোনা গেল রবিনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। এতোক্ষণ কি করছিলে?
আর বলো না, পথ হারিয়েছিলাম। টর্চ ছাড়া বেরোনোই উচিত হয়নি। রাফি সাথে না থাকলে আজ আর তাঁবুতে ফিরতে পারতাম না।
কি দেখে চেঁচামেচি করল জানতে চাইলো জিনা। প্রজাপতি মানব, ডরি। ও বললো মিস্টার ডাউসনও নাকি বেরিয়েছেন।
কেন? মুসা বললো। ঝড় আসছে দেখছে না? মথ-টথ কি আর বেরোবে নাকি এখন। নিশ্চয় বাসায় ঢুকে বসে আছে।
মধু-ধরা ফাঁদ দেখতে বেরিয়েছে নাকি। যদি ধরা-টরা পড়ে থাকে? কিশোর জানালো। কোথায় যেন পড়েছি, হে ডালে মধু মাখিয়ে রাখা হয়। সেই মধুর গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে মথ এসে সেখানে পড়ে। তখন ওগুলোকে ধরা মোটেই কঠিন না।
তাই নাকি? মজার ব্যাপার তো, মুসা বললো। দেখতে যেতে পারলে হতো।…এহহে, বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করেছে। ডরি আর তার মথ, সবাই ভিজবে। চলো চলো, তাঁবুতে চলল।
এবার আর বাইরে থাকতে চাইলো না রাফিয়ান। পানির বড় বড় ফোঁটা ভালো লাগলো না মোটেও। সবার আগেই ঢুকে পড়লো তাঁবুর ভেতর। বসলো রবিন আর জিনার পাশে।
জায়গা তো সব তুইই দখল করে ফেললি, রাফি, হেসে বললো জিনা। আরেকটু ছোট হতে পারলি না।
জবাবে জিনার হাঁটুতে মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাফি। যেন তার দুঃখ বুঝতে পেরেছে। _ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিনা বললো, কাণ্ড দেখে। ওরকম বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিস কেন? তোর আবার কিসের দুঃখ? ও, বুঝেছি। বাইরে বসে শজারু দেখতে পারবি না, হাঁকডাক করতে পারবি না, এই জন্যে?
বসে বসে কি করি? ঘুমও তো আসছে না, কিশোর বললো। তার টর্চটা জেলে,শুইয়ে রেখেছে রেডিওর ওপর। রেডিওতেও বোধহয় শোনার মতো কিছু নেই।
গল্প করা ছাড়া আর কি করার আছে? জিনা বললো। এক কাজ করো, তোমাদের অথৈ সাগর ভ্রমণের গল্পটা আরেকবার বলো। অনেক মজা করে এসেছে।
মজা না ছাই, গজগজ করলো মুসা। ছাইভস্ম কতো কি যে খেলাম। শুঁয়াপোকাও বাদ দিইনি?
ওই শুঁয়াপোকাই বলতে গেলে জান বাঁচালো আমাদের, রবিন বললো। ওগুলো খেয়ে খানিকটা শক্তি পেয়েই না আবার খাবার খুঁজতে পেরেছি। নইলে তো মরেছিলাম। আরিব্বাপরে, যা রোদ আর গরম ছিলো, জিনা, কি বলবো? কুমালো ওদিকে গুলি খেয়ে বেহুশ, মরে মরে অবস্থা। পানি নেই। বড় বাঁচা বেঁচে এসেছি। জীবনে আর ওমুখো হচ্ছি না আমি।
আমার কিন্তু অতো খারাপ লাগেনি, কিশোর বললো। দ্বীপটা ছেড়ে আসতে শেষে কষ্টই হয়েছে।
বলোই না আরেকবার গল্পটা, অনুরোধ করলো জিনা।
গুছিয়ে গল্প বলায় ওস্তাদ রবিন। কেস-ফাইল লিখতে লিখতে এটা রপ্ত করেছে। সে-ই আরম্ভ করলো।
বাইরে ভালোমতোই শুরু হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি। ছোই তাঁবুটাকে হ্যাঁচকা টানে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে প্রবল বাতাস।
গল্প বলে চলেছে রবিন। মুসাকে অক্টোপাসে ধরে মারার উপক্রম করেছে, সেই জায়গাটায় এসেছে, তন্ময় হয়ে শুনছে সবাই, এই সময় নিতান্ত বেরসিকের মতো ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো রাফিয়ান। চমকে দিলো সবাইকে। শুধু চেঁচিয়েই ক্ষান্ত হলো না। তাবুর ফাঁকে নাক ঢুকিয়ে ঠেলে মাথাটা বের করে দিলো বাইরে। আরও জোরে চেঁচাতে লাগলো।
মরেছে! আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো আমার, বলে উঠলো মুসা। এই রাফি, তোর হলো কি?…আরে আরে দেখো, আবার বেরিয়ে গেল। এই, ভিজে ঠাণ্ডা লাগাবি তো। কি দেখতে গেছিস? দুটো পাগলকে? ওরা মথ ধরতে এসেছে…আয়, আয়।
কিন্তু ফিরেও এলো না রাই, চিৎকারও থামালো না। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চলেছে। কিশোর গিয়ে টেনে আনার চেষ্টা করলে তার দিকে তাকিয়ে রেগে উঠলো। শেষে জিনা গিয়ে তাকে ধরে আনলো।
ব্যাপারটা কি? কিছুটা অবাকই হয়েছে কিশোর। এই রাফি, চুপ কর না। কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলি তো।
কোনো কিছু উত্তেজিত করেছে তাকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো জিনা। অস্বাভাবিক কিছু!…এই শোনো, শোনো, একটা চিৎকার শুনলে?
কান পাতলো সবাই। কিন্তু ঝড়ো বাতাস আর তাঁবুর গায়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আর কিছু শোনার উপায় নেই।
কিছু থাকলেও এখন যাওয়া সম্ভব না, মুসা বললো। ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবো। আর এই বৃষ্টিতে খুঁজে বের করাও মুশকিল হবে। রাফি, চুপ কর। যেতে পারবো না।
তবু থামলো না রাফি।
শেষে রেগে গেল জিনা। ধমক লাগালো, এই, চুপ করলি! হতচ্ছাড়া কুত্তা কোথাকার!
রেগে এভাবে তাকে খুব কমই গালি দেয় জিনা। অবাক হয়ে চুপ করলো সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগলো জিনার মুখের দিকে।
হয়েছে, আর ওরকম করে তাকাতে হবে না, পাজি কোথাকার! চুপ, একদম চুপ! ইঁদুর, ছুঁচো যা দেখবে চেঁচাতে শুরু করবে। আর একটা চিৎকার করলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেবো…।
জিনার কথা শেষ হলো না। ঝড়ের গর্জন আর মুষলধারে বৃষ্টির ঝপঝপ ছাপিয়ে শোনা গেল আরেকটা ভারি গোঁ গোঁ আওয়াজ ইঞ্জিনের।
চট করে পরস্পরের দিকে তাকালো চারজনে।
খাইছে! এরোপ্লেন! ফিসফিস করে বললো মুসা, যেন বিমানটা শুনতে পাবে তার কথা। এই ঝড়বৃষ্টির মাঝে বেরোলোয় ব্যাপারটা কি?
৮
অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো ওরা। এমন কি জরুরী ব্যাপার ঘটলো যে এই দুর্যোগের মাঝেওউড়তে হলো বিমানটাকে?