সত্যিই তাই। এক ঘণ্টাও লাগলো না। বিশাল ঝোপের ধারে খাঁটিয়ে ফেলা হলো তাঁবু।
ভালোই খাঁটিয়েছি, কি বললো, তাঁবু দেখতে দেখতে নিজেদের তারি করলো মুসা। সাধারণ বাতাস তো দুরের কথা, হারিকেন এলেও উড়িয়ে নিতে পারবে না। আরামেই থাকবো ভেতরে। এখন বিছানা করে ফেলা দরকার। কম্বল আজ গায়ে দিতে হবে, কাজেই বিছানো চলবে না। বড় আর পাতা দিয়েই বিছানা করতে হবে।
কাছেই গমের খেতের ফসল সবে কাটা হয়েছে। সেখান থেকে খড় তুলে আনলো ওরা। ঝোপের অভাব নেই, পাতারও অভাব হলো না। প্রচুর পাতা জোগাড় করে আনা হলো। সেসব বিছিয়ে তৈরি করে ফেলা হলো চমৎকার পুরু আর নরম গদির মতো বিছানা। তার ওপর যার যার অ্যানারাক বিছিয়ে দিয়ে চাঁদরের কাজ সারলো।
কাজ সেরে বাইরে এসে আরেকবার তাকালো আকাশের দিকে। নাহ, বৃষ্টি আসবেই, আর কোনো সন্দেহ নেই। সেই সাথে ঝড়ও আসতে পারে। তবে ওদের আশা-সকালে থেমে যাবে বৃষ্টি। আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবার বাইরে বেরোতে পারবে ওরা। আর যদি না-ই হয়, কি আর করা, চলে যাবে গুহা দেখতে।
মেঘ করায় স্বাভাবিক সময়ের আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে। তাঁবু খাটানো হয়েছে দুটো, কিন্তু ঘুমানোর আগে এক তাবুতে বসে গল্প করবে ঠিক করলো ওরা। রেডিও শুনবে। তাবুতে ঢুকে চালু করে দিলো রেডিও। রাফিকে ডাকলো জিনা। কিন্তু ভেতরে এলো না কুকুরটা, বাইরেই শুয়ে থাকলো। বোধহয় আরাম লাগছে ওখানেই।
রেডিওটা সবে অন করেছে কিশোর, এই সময় ঘেউ ঘেউ করে উঠলো রাফিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে সুইচ অফ করে দিলো সে।
নিশ্চয় কেউ আসছে, জিনা বললো। কে?
হয়তো জনি, আন্দাজ করলো মুসা। আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যেতে আসছে।
নাকি আঁধার রাতে মথ খুঁজতে বেরোলেন মিস্টার ডাউসন, হেসে বললো রবিন।
হাসলো কিশোর। মুসার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, বলা যায় না, মিসেস ডেনভারও হতে পারে। ঝড়ের রাতে কাউকে যাদু করতে বেরিয়েছে হয়তো।
দূর, বাজে কথা বলো না তো, গায়ে কাঁটা দিল মুসার। আল্লাহ না করুক। মিসেস ডেনভার ভালো মানুষ, ডাইনী নয়। তাছাড়া পৃথিবীতে ডাইনী বলে কিছু নেই…
তা-ই নাকি? আরে, আমাদের মুসা আমান বলে কি? ভূতপ্রেতের ওপর থেকে বিশ্বাস তাহলে উঠে যাচ্ছে তোমার। আশ্চর্য!
ভূতের কথায় আরও কুঁকড়ে গেল মুসা।
কিশোরের সঙ্গে সঙ্গে রবিন আর জিনাও হাসতে আরু করলো।
ওদিকে ডেকেই চলেছে রাফিয়ান।
কে এলো, দেখতে হয়। বলে তাবুর দরজা দিয়ে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, এই রাফি, কে-রে?
মুখও ফেরালো না রাফিয়ান। কিশোরের কথা যেন কানেই যায়নি। একই দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে চলেছে। নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে।
শজারু-টজারু হবে, ভেতর থেকে বললো জিনা।
কি জানি। তবে আমার মনে হয় ওকে নিয়ে গিয়ে দেখা উচিত কি দেখেছে। জানা দরকার। অন্য কিছুও হতে পারে।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লো কিশোর। আয়, রাফি। কি দেখেছিস? দেখা তো আমাকে।
লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটলো রাফিয়ান। পেছনে প্রায় দৌড়ে এগোলো কিশোর। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। গাছের শেকড়ে কিংবা লতায় লেগে হোঁচট খাচ্ছে। টর্চ আনা উচিত ছিলো, ভাবলো সে। এখন আর আনার সময় নেই। অনেকখানি চলে এসেছে।
ঢাল বেয়ে দৌড়ে চললো কিছুক্ষণ রাফিয়ান, এয়ারফীন্ডের দিকে মুখ। তারপর বার্চ গাছের একটা জটলার পাশ কাটিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আরও জোরে চিল্কার করতে লাগলো।
আবছামতো একটা ছায়া নড়তে দেখলো কিশোর। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, কে?
আমি…আমি…, জবাব দিলো একটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠ। ডরি।
ছায়ার হাতে লম্বা লাঠির মাথায় জালের মতো দেখতে পেলো কিশোর।
আমাদের ফাঁদগুলো দেখতে এসেছি, আবার বললো ডরি। ঝড় আসছে তো। ভাবলাম, দেখেই যাই কোনো মথ-টথ পড়লো কিনা। বৃষ্টি এলে সব ধুয়ে চলে যাবে, পরে এসে কিছুই পাবে না।
ও, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। আমি ভেবেছিলাম না জানি কি। তা মিস্টার ডাউসনও বেরিয়েছেন নাকি?
যা! রাতে প্রায়ই বেরোই আমরা, মথ শিকারে। কাজেই যদি তোমাদের কুকুরটা রাতে ডেকে ওঠে, যখনই ডাকুক, ধরে নেবে আমরা।…চেঁচিয়ে তো কান ঝালাপালা করে দিলো ওটা! থামাও না। বড় পাজি কুকুর মনে হচ্ছে।
এই রাফি, চুপ! ধমক দিয়ে বললো কিশোর। লোক চিনতে পারিস না?
চুপ হয়ে গেল বটে রাফি, কিন্তু তার অস্বস্তি দূর হলো না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ছায়াটাকে।
আরেকটা ফাঁদ দেখতে যাচ্ছি আমি, ডরি বললো। তোমরা যাও। কুকুরটার মুখ বন্ধ রাখতে বলবে।
টর্চ জ্বলে উঠলো ডরির হাতে। হাঁটার তালে নেচে নেচে এগিয়ে চললো আলোটা।
আমরা এই পাহাড়েই ক্যাম্প করেছি, কিশোর বললো। এই তো, বড় জোর শখানেক গজ হবে। ইস, টর্চ আনলে আপনার সঙ্গে যেতে পারতাম। রাতে মথ ধরা দেখতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয় খুব ভালো লাগতো।
জবাব দিলো না লোকটা। চলে যাচ্ছে। যতোই দূরে সরছে, ধীরে ধীরে স্নান হয়ে আসছে টর্চের আলো।
ফিরে চললো কিশোর। অন্ধকারে দিক ঠিক রাখাই মুশকিল। আরও নানারকম অসুবিধে তো রয়েছেই। একশো গজ যেতেই পথ হারালো সে। ক্যাম্পের কাছ থেকে অনেক ডানে সরে গেল। অবাক হলো রাফি। কিশোরের শার্টের হাতা কামড়ে ধরে আস্তে টান দিলো।
কি-রে। দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। পথ ভুল করলাম নাকি? সর্বনাশ, তুই না থাকলে তো এই অন্ধকারে সারারাত ঘুরে মরতাম! তবু কিছুতে খুঁজে পেতাম না। যা, পথ দেখা।