দরজা খুলে গেল। বিড়বিড় করে কি বললো মহিলা, বোঝা গেল না। তারপর বললো, তোমরা চলে যাও। আমার ছেলে এসে দেখলে তোমাদের তো গালমন্দ করবেই, আমাকেও মারবে। চলে যাও তোমরা।
যাচ্ছি। এই নিন, বলে টাকাটা মহিলার হাতে গুঁজে দিলো রবিন।
হাতের তালুতে ডলারটা দেখে বিশ্বাসই করতে পারলো না মিসেস ডেনভার। তারপর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়া জুতোর ভেতরে ওটা লুকিয়ে ফেললো। আবার যখন সোজা হলো, দেখা গেল তার চোখে পানি টলমল করছে। তোমরা খুব ভালো! সে-জনন্যই বলছি, চলে যাও। আমার ছেলেটা মানুষ না! তোমাদেরকেও মেরে বসতে পারে। চলে যাও, প্লীজ!
নীরবে ওখান থেকে সরে এলো ওরা।
আজব এক জায়গা! হাঁটতে হাঁটতে বললো কিশোর। দুজন প্রজাপতি মানব, একসাথে থাকে, অথচ আচার ব্যবহারে একজনের সঙ্গে আরেকজনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। একজন মহিলা, তার ব্যবহার আরও অদ্ভুত। ছেলের কথা যা শুনি, ওটা নিশ্চয় আরেক পাগল! বুঝতে পারছি, আবার আসতে হবে এখানে।
তারমানে রহস্যের ভূত ঘাড়ে চেপেছে তোমার, হেসে বললো মুসা।
কেন, তোমার কাছে রহস্যময় লাগছে না?
লাগছে।
আমি অবাক হচ্ছি, রবিন বললো, ডরি প্রজাপতিটা চিনতে পারলো না দেখে। প্রজাপতির ব্যবসা করে, অথচ…কি জানি, হয়তো খালি বেচাকেনা নিয়েই থাকে লোকটা। কোনটা কোন প্রজাপতি তার ধার ধারে না।
কিন্তু বেচাকেনা করতে গেলে জিনিস চিনতে হয় না? জিনা প্রশ্ন তুললো। লোকে যখন বলে এই জাতের প্রজাপতি দিন, ওই জাতের শুঁয়াপোকা দিন, না চিনলে কি করে দেয়?
তা-ও কথা ঠিক, মাথা দোলালো রবিন। নাহ, পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময়!
ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা। এসেই সোজা ভাঁড়ারের দিকে রওনা হলো রাফিয়ান। হাত নেড়ে রবিন বললো, না না, রাফি, যাসনে। খাবার সময় হয়নি এখনও।
এখন কি করবো? শুয়ে পড়েছে মুসা। সুন্দর বিকেল।
তা ঠিক। কিন্তু রাতে আর সুন্দর থাকবে বলে মনে হয় না, কিশোর বললো পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে। মেঘ জমছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে।
আমারও মনে হয়, জিনা বললো। সাগরের তীরে বাড়ি। কখন বৃষ্টি আসে না আসে মোটামুটি আঁচ করতে পারে। দূর! আর একটা হপ্তা অপেক্ষা করতে পারলো
আকাশ! এখন বৃষ্টি এলে উপায় আছে? সারাদিন তাবুতে বসে থাকতে হবে। ক্যাম্পিঙের আর কোনো মানে হবে না।
যখন আসে আসবে, রবিন বললো। এখন ওসব ভেবে লাভ নেই। বৃষ্টি এলে বসে থাকবো কেন? গুহাগুলো দেখতে চলে যাবো। এখন এসো, মিউজিক শুনি। আবহাওয়ার খবর খারাপ হলে তা-ও জানতে পারবো।
বেশ, চলো তাহলে মিউজিকই শুনি, জিনা বললো। আজ বিকেলে কোনো এক সময়ে প্যাসট্রোল সিমফনি বাজানোর কথা। ঘোষণা শুনেছি, তবে সময়টা ঠিক মনে নেই। এখানে, এই পাহাড়ী গাঁয়ে, ওই মিউজিক শুনতে দারুণ লাগবে। তবে অবশ্যই ভলিউম কমিয়ে শুনতে হবে। জোরে শুনতে ভালো লাগে না ওই বাজনা।
বাবারে, একেবারে কবি হয়ে যাচ্ছে দেখি আমাদের জিনা বেগম, হেসে ঠাট্টা করলো মুসা।
পানি-নিরোধক খাপ থেকে রেডিওটা বের করলো কিশোর। সুইচ টিপে স্টেশন টিউন করতেই শোনা গেল মোটা কণ্ঠ, সংবাদ এখনকার মতো শেষ হলো। ধন্যবাদ।
আহহা, শেষ হয়ে গেল, বললো কিশোর। আবহাওয়ার খবরটা শোনা উচিত ছিলো। যাকগে, পরের বার শুনবো।
শোনা গেল ঘোষকের গলা। হ্যাঁ, জিনা ঠিকই বলেছে, প্যাসট্রোল সিমফনিই শোনানো হবে। নরম, হালকা লয়ে শুরু হলো বাজনা। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো যেন পাহাড়ী প্রকৃতি জুড়ে। যেন এই পরিবেশে শোনার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে ওই মিউজিক। রেডিওটা সামনে রেখে আরাম করে জাঁকিয়ে বসলো চারজনে। কারো মুখে কথা নেই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পশ্চিম আকাশে অপরূপ রঙের খেলা। ধীরে ধীরে দিগন্তে নামছে সূর্য।
ওদিকে একই দিগন্তের কোল থেকে উঠে আসছে মেঘের স্তর। সূর্যটা হারিয়ে গেল তার ওপাশে। মন খারাপ হয়ে গেল ওদের।
ঠিক এই সময়, বাজনা ছাপিয়ে সোনা গেল আরেকটা শব্দ। বিমান।
এতো আচমকা আর এতো জোরে হলো শব্দটা, চমকে গেল শ্রোতারা। ঘেউ ঘেউ শুরু করলো রাফিয়ান।
কোথায় ওটা? দেখতে না পেয়ে অবাক হয়েছে মুসা। কাছেই মনে হচ্ছে,
অথচ দেখছি না! জনির ভাই জ্যাক ওড়াচ্ছে না তো?
ওই যে, কিশোর হাত তুললো।
পাহাড় পেরিয়ে উড়ে আসতে দেখা গেল হোট বিমানটাকে। ওদের মাথার ওপর একবার চক্কর দিয়ে চলে গেল এয়ারফীন্ডের দিকে।
ছন্দপতন ঘটালো এই বিকট আওয়াজ। বাজনা শুনতে আর ভালো লাগলো না ওদের।
৭
রাতের খাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগলো ওরা। রবিন আর জিনা গিয়ে খাবার নিয়ে এলো ভাঁড়ার থেকে। রাফিয়ান গেছে সাথে, যদি কোনো সাহায্য করতে পারে এই আশায়। কিন্তু মুখে ঝুলিয়ে আনার মতো কিছু না থাকায় খালিমুখেই ফিরতে হয়েছে তাকে।
খেতে বসে বার বার অস্বস্তিভরে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাতে লাগলো কিশোর। নাহ, বৃষ্টিটা বোধহয় আসবেই। দেখো, ইতিমধ্যেই অর্ধেক আকাশ ছেয়ে ফেলেছে মেযে। সূর্য তো সেই যে ঢুকেছে মেঘের মধ্যে, আর বেরোচ্ছে না। মনে হয় আজ তাঁবু খাটাতেই হবে।
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলালো জিনা।
করলে তাড়াতাড়ি করতে হবে, মুসা বললো। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। রাতে আজ শীতই লাগবে।
চলো, তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে ঝোপের ভেতর থেকে বের করে ফেলি, রবিন বললো। চারজনে হাত লাগালে বেশিক্ষণ লাগবে না তাবু খাটাতে।