কি জিজ্ঞেস করছেন! বলে উঠল রাগত একটা কণ্ঠ, ধরে লাগান না ধোলাই! পথেঘাটে চুরি, ছিনতাই, বোমাবাজি অতিষ্ঠ করে ফেললো!
মোটা একটা বেতের লাঠিতে ভর দিয়ে পুলিশের ভিড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধ। পরনে অবিন্যস্ত পোশাক। পেছন পেছন এলো এক তরুণ আর সতেরো আঠারো বছরের আরেক তরুণী।
চোর কোথাকার! তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠলেন বৃদ্ধ, আমার ঈগল কোথায়?
একটা পেট্রল কার থেকে নেমে এলেন পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর। বুকে। ঝোলানো ফলকে নাম লেখা, হাফিজ আলি। তিন গোয়েন্দাকে দেখে সার্জেন্টের মতোই অবাক হলেন তিনিও। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থেকে একই প্রশ্ন করলেন, তোমাদের পরিচয়?
পরিচয়-ফরিচয় পড়ে! ধমকে উঠলেন বৃদ্ধ। আমার ঈগলটা কোথায় আগে জিজ্ঞেস করুন! ধরে পেটান না…
আহ, থামুন তো আপনি, হাত তুলে বললেন পুলিশ অফিসার। আবার তাকালেন ছেলেদের দিকে, এখানে কি করছো তোমরা?
উ…উই… ইংরেজিতে বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। বাংলায় তোতলাতে শুরু করলো, আ-আমরা-চো-চো-চো…,
চোর নই, বাক্যটা শেষ করে দিলো কিশোর। বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললো, ইনি ভুল করছেন।
কি বলতে যাচ্ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর, চেঁচিয়ে বললো একজন কনস্টেবল, স্যার, আরেক ব্যাটাকে ধরেছি! লুকিয়ে ছিলো! কচিকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে সে।
চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ, আরি, ওটাকে চিনি তো! তিন-তিনবার দেখেছি একটা পিকআপের কাছে, আর তিনবারই কাঁচ ভেঙেছিলো, গাড়িটার!
ওটা আমাদেরই গাড়ি, কচি বললো। মাল ডেলিভারি দিতে এসেছিলাম। কে জানি ভেঙে রেখে গেছে।
এটা কার? সামনের গাড়িটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সাব-ইন্সপেক্টর।
ওসব কথা বাদ দিন না! খেপে গেলেন বৃদ্ধ। আমার ঈগল কোথায় জিজ্ঞেস করুন!
আপনি স্যার থামুন না! বিরক্ত হয়ে বললেন পুলিশ অফিসার। আমরাই তো করছি যা করার। আপনি চুপ থাকুন, প্লীজ।
গজগজ করতে লাগলেন বৃদ্ধ।
কিশোর বললো, দেখুন, আমরা গাড়ির কাঁচ ভাঙতে আসিনি। চুরি করতেও নয়।
বার বার চোর চোর শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে গেছে মুসা। চমকের প্রথম ধাক্কাটাও কাটিয়ে উঠেছে। রেগে গেল। ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে বললো, ঈগল ভেরি বিগ পাখি। পকেটে ভরে রেখেছি নাকি?
ঠিক, বাংলায় বললো রবিন। পরের কথাটা বললো ইংরেজিতে, পাখি চুরি করতে যাবো কোন দুঃখে?
সেটা আমি কি জানি? চুপ থাকতে পারছেন না বৃদ্ধ। মুখ ভেঙচালেন, এহ্, ভেরি বিগ পাখি! ন্যাকামো হচ্ছে! জানো না কি পাখি…।
আরেকজন কনস্টেবল চেঁচিয়ে উঠলো, স্যরি, এই গাড়িটা চিনি! নাম্বার প্লেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চৌধুরী সাহেবের! আরিফুর রহমান চৌধুরী! ডি আই জি ছিলেন…
হ্যাঁ, আমারই, পেছন থেকে শোনা গেল ভারি কণ্ঠ।
ঝট করে ফিরে তাকালেন সাব-ইন্সপেক্টর। স্যার, আপনি?
অ্যাটেনশন হয়ে গেলেন তিনি আর তার দলের লোকেরা। স্যালুট করলেন।
সালামের জবাব দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন ভূতপূর্ব ডি আই জি, হ্যাঁ। কাঁচ ভাঙে কে ধরতে এসেছি। কিশোরকে দেখিয়ে বললেন, ও আমার ভাগ্নে, কিশোর পাশা। আমেরিকায় থাকে। বেড়াতে এসেছে।…আর এরা ওর বন্ধু। ও মুসা আমান।…ও রবিন মিলফোর্ড। গোয়েন্দাগিরির খুব শখ। নামটাম ভালোই করেছে ওখানে।
আমি ওদের কথা জানি, স্যার, হাসিমুখে বললো একজন কনস্টেবল। পড়েছি। তিন গোয়েন্দা।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন চৌধুরী সাহেব।
ফোন করে ডেকে আনলাম চোর ভেবে, বিড়বিড় করলেন বৃদ্ধ। এখন শুনি গোয়েন্দা। অস্থির ভঙ্গিতে রাস্তায় বেত ঠুকতে ঠুকতে বললেন, আমার ঈগলটা কি পাবো না?
.
০৫.
এরা যে লুকিয়ে আছে, আপনারা খবর পেলেন কোথায়? চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
কথা হচ্ছে বৃদ্ধ আকবর আলি খানের ড্রইংরুমে বসে, তিন গোয়েন্দাকে চোর ভেবে বসেছেন যিনি। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে কিশোর। আসবাবপত্র খুব দামী, কিন্তু পুরানো ধাচের। জমিদারী আমলের জিনিসের মতো ভারি আর নকশা করা। বসার ঘরে দেয়ালে টানানো আকবর আলি খানের তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের একটা ছবি। পরনে কালো স্যুট। ঠিক একই রকম পোশাক পরেন এখনও। কিছুতেই যেন সময়টা পার হয়ে আসতে পারেননি, কিংবা হয়তো চাই না।
দুমাস ধরেই ধরার চেষ্টা করছি, স্যার, সার্জেন্ট জানালেন। অনেকেই খবর। দিচ্ছে, রহস্যময় ভাবে গাড়ির উইণ্ডশীল্ড ভেঙে রেখে যাচ্ছে কেউ। গত হপ্তায় খান। সাহেবও থানায় ডাইরি করে এসেছেন, বৃদ্ধকে দেখালেন তিনি। তাঁর গাড়ির কাঁচ ভেঙে ভেতর থেকে ঈগলটা রে করে নিয়ে গেছে। বাড়ির সামনে তখন ছিলো গাড়িটা। ভুলে ঈগলটা রয়ে গিয়েছিলো গাড়িতে। খানিক পরে মনে পড়তেই ছুটে গিয়ে দেখেন গাড়ির কাঁচ ভাঙা, ঈগল উধাও। তারপর থেকেই রাস্তার ওপর চোখ রাখেন। পরশুদিন রাতেও নাকি তিনজন ছেলেকে বাড়ির সামনের রাস্তায়, ঝোঁপের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখেছেন। আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে রেখেছেন। আজও যখন এদেরকে দেখলেন, তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন আবদুল আজিজ, ফোন করলেন থানায়। আমি তখন চৌরাস্তার মোড়ে ডিউটিতে ছিলাম। অয়্যারলেসে আমাকে জানিয়েছেন সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ আলি।
জানালার কাঁচ ভাঙার পর, রবিন বললো, উড়ে পালিয়েছে হয়তো ঈগলটা।
মুসা বললো, ঈগল ডেঞ্জারাস পাখি। ছেড়ে রাখা হয় না। পালালো কিভাবে?