দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল মুসা। এই কষ্টটা কেন করতে গেলে?-বলে যে সৌজন্যটুকু দেখাবে সেকথাও ভুলে গেল। ভাবতেই পারেনি এভাবে রস নিয়ে হাজির হয়ে যাবে আবদুল করিম।
এই নে, গেলাস, পেছন থেকে মামীর কথায় সংবিৎ ফিরলো যেন তার।
গেলাসটা নিয়ে হাসলো মুসা। বাড়িয়ে দিলো করিমের দিকে। দাও।
কলসের মুখে পরিষ্কার গামছা বাধা। সাদা ফেনা জমে রয়েছে। রস ঢেলে দিলো করিম।
হাতে নিয়ে পানীয়টুকু ভালো করে দেখলো মুসী। এই জিনিস আগে কখনও দেখেনি সে। গন্ধ শুকলো। তারপর চুমুক দিলো গেলাসে। দিয়েই বলে উঠলো, হখাইছে! এতো মিষ্টি! বলেই ঢকঢক করে সবটুকু গিলে ফেলে আবার গেলাসটা বাড়িয়ে দিলো।
গিলে চলেছে মুসা। আর ক্রমেই বাড়ছে করিমের হাসি। দারুণ মজা পাচ্ছে। গ্রামে ওরা বন্ধুরা মিলে বাজি ধরে রস খায়। সবাই প্রচুর খেতে পারে। কিন্তু এখন তার মনে হলো, মুসার ধারে কাছে যেতে পারবে না কেউ।
চলেন, একদিন আমাগো বাড়িত গিয়া বাজি ধইরা খাইবেন? প্রস্তাব দিয়ে ফেলল করিম।
না বুঝেই মাথা কাত করলো মুসা, আচ্ছা। আবার বাড়িয়ে দিলো গেলাস।
একের পর এক গেলাস খালি করে অবশেষে ওটা করিমের হাতে দিতে দিতে। মস্ত ঢেকুর তুলল সে, নাও, আর পারবো না।
একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো মুসা। ঢোল হয়ে যাওয়া পেটে হাত বোলাচ্ছে। কিশোর আর রবিনও এসেছে। ওদেরকে বললো, দারুণ টেস্ট, বুঝলে। খেয়ে দেখো। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো সে। এতো মজা, লোভ সামলাতে পারিনি। এর সঙ্গে কোথায় লাগে পেপসি-কোক-ফান্টা…
রস খাওয়া শেষ হলো। কিছুতেই পয়সা নিতে চাইলো না আবদুল করিম। কিন্তু তিনজনের কাছ থেকে তিনটে ভনির তাকে নিতেই হলো। আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা। রবিন দিলো ইলেকট্রনিক ঘড়ি বসানো একট বলপেন। কিশোর দিলো একটা পকেট নাইফ। মুসা দিল সুন্দর একটা গেঞ্জি আর একবাক্স চকলেট।
খুব খুশি হলো করিম। ওদেরকে আবারও খাওয়ার দাওয়াত দিলো। একেবারে নাছোড়বান্দা। কথা আদায় না করে যাবেই না।
শেষে কিশোর বলল, ঠিক আছে, যাবো, তবে আজ না। আজ তো বুধবার, যেতে পারবো না। আরেক দিন।
বুধবারে কি অসুবিধা বুঝতে পারলো না করিম। জিজ্ঞেসও করলো না। জানতে চাইলো, আরেক দিন কবে?
কালও হতে পারে। এসো একবার যেতে পারলে চলে যাবো।
আচ্ছা, বলে উঠে পড়লো করিম।
.
দিনের বেলাটা নানা জায়গায় ঘুরে কাটালো তিন গোয়েন্দা। সোনার গাঁ দেখে এলো। বিকেল বেলা ফিরে খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। রাতের খাওয়ার পর বেরোলো আবার, গাড়ি নিয়ে, মামার সঙ্গে।
সোমবার আর বুধবারেই ঘটে কাঁচ ভাঙার ঘটনাগুলো।
আগের বারের মতোই সেদিনও সাত নম্বর রোডের মোড়ে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দিলেন চৌধুরী সাহেব। নির্দিষ্ট জায়গায় এনে গাড়ি পার্ক করলেন। কচি নেমে চলে গেল একটা বাড়ির ছায়ার দিকে। তিনি চললেন মোড়ের চায়ের। দোকানে।
আগের দিনের মতোই ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে বসলো তিন গোয়েন্দা।
প্রথমে এলো সেই লম্বা বিদেশী মহিলা। হাতে লাঠি, সঙ্গে কুকুর। সেদিনের। মতোই সব কিছু শুঁকতে শুঁকতে এলো কুকুরটা, লাফ দিয়ে গাড়ির কাঁচে পা তুলে দিলো, ধমক দিয়ে তাকে নামিয়ে নিলো মহিলা।
ফিক করে হেসে ফেললো মুসা।
কুকুরটাকে নিয়ে চলে গেল মহিলা। আবার নীরব হয়ে গেল রাস্তা।
এরপর গোটা দুই গাড়ি হুস হুস করে বেরিয়ে গেল। পার্ক করে রাখা গাড়িটার কাছে এসেও একটু গতি কমালো না।
দ্বিতীয় গাড়িটা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলো সেই বিচিত্র পোশাক পরা তরুণ। টেন-স্পীড সাইকেলে করে। সেদিন তো পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গতি কমিয়েছিলো, আজ তা-ও কমালো না। শাই শাই করে সোজা ছুটে গিয়ে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা উপ-গলিতে।
ঝোঁপের আড়ালে অপেক্ষা করে আছে ছেলেরা।
দশটার দিকে মোড়ের কাছে আরেকটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। আরও কাছে এলে দেখা গেল একটা ফোক্স ওয়াগেন। অদ্ভুত রঙ করেছে–ওপরের অংশটা বেগুনী, নিচের অংশ হলুদ। তোবড়ানো ফেনড়ার। সামনের বাম্পারের একপাশ খুলে গেছে, আরেক পাশ ছুটলেই খসে পড়ে যাবে। ইঞ্জিনের ভারি শব্দ আর ঝুলে পড়া বাম্পারের ঝনঝন আওয়াজ তুলে এগিয়ে এলো ওটা। পার্ক করা গাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো কি একটা জিনিস। গিয়ে পড়ল গাড়িটার নিচে।
কি ছুঁড়লো! চেঁচিয়ে বললো মুসা।
চল, দেখি! কিশোর বললো।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো তিনজনে। ছুটে রাস্তা পেরিয়ে এসে উঁকি দিলো গাড়ির নিচে। টর্চের আলোয় জিনিসটা দেখে মুখ বাকলিলা কিশোর।
জিনিসটা বের করে আনলো মুসা। ভীষণ নিরাশ হয়েছে।
সিগারেটের প্যাকেট! বিড়বিড় করলো রবিন। ভেতরে কিছু নেই তো?
খুলে দেখলো মুসা। কিচ্ছু নেই! নিমের তেতো ঝরলো তার কণ্ঠ থেকে, ধুর…
কথা শেষ হলো না তার। হঠাৎ বেজে উঠলো সাইরেন। মোড়ের কাছে দেখা দিলো পুলিশের গাড়ি। হাতের ওপরে লাল-নীল আলো জ্বলছে-নিভছে। পথের আরেক মাথায় একটা উপ-গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একই রকম আরেকটা গাড়ি।
তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে ফেললো পুলিশ।
.
পুলিশের গাড়িতে বসানো সার্চ লাইটের আলো এসে পড়লো ওদের গায়ে এগিয়ে এলেন একজন গম্ভীরমুখো সার্জেন্ট। বুকে প্ল্যাস্টিকের ফলক ঝুলছে, তাতে নাম লেখাঃ আবদুল আজিজ। এক এক করে তাকালেন কিশোর, মুসা আর রবিনের মুখের দিকে। শেষ দুজনকে দেখে অবাক হয়েছেন, বোঝা গেল। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পরিচয়?