ওদের হাতে কিছু নেই দেখে আশ্বস্ত হলো পাখিটা, তবে সতর্কতা কমলো না। ব্যাপারটা লক্ষ করলো মুসা। বকটা ওরকম করছে কেন জিজ্ঞেস করলো। এয়ারগানের কথা জানালো কচি।
আরও খানিক দূর গিয়ে একটা বড় মাছরাঙা দেখা গেল। পানিতে পড়ে থাকা মরা পচা ডালের ওপর বসে আছে। ওদেরকে দেখে ওটাও সতর্ক হয়ে গেল। ওরা আরও খানিকটা এগোতেই চিড়ড়িক ডাক ছেড়ে উড়ে চলে গেল।
এটারও কি এয়ারগানের ভয়?
চড়ুই থেকে শুরু করে কিছুই তো বাদ দেয় না ছেলেগুলো।
এগিয়ে চলেছে ওরা। পায়ে চলা পথের কিনারে এখন খানিক পর পরই খেজুর গাছ। পথের পাশে খেত আছে এখানেও। তবে ফসলের খেতের মতো শূন্য নয়। শীতকালীন শাকসজিতে সবুজ হয়ে আছে। কোথাও সরষে খেতের হলদে ফুলের শোভা। তার ওপর এসে পড়েছে বিকেলের পড়ন্ত সোনালি রোদ।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেই ফেললো মুসা, কিশোর, তোমাদের দেশটা সত্যিই সুন্দর! এতোদিন তো শুধু শুনেছি, আজ দেখলাম…
জবাব দিলো না কিশোর। শুধু মাথা ঝাঁকালো। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে তার। মায়াময় দুই চোখ। গুনগুন কবে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…
পেছনে সূর্য ডুবছে। খেজুর গাছে শালিক আর শ্যামার ভিড়। বেশির ভাগই ডাকছে নানান সুরে। কোন কোনটা এসে বসেছে রসের কলসের কানায়। রস বেয়ে পড়ার কাঠিতে ঠোঁট ডুবিয়ে রস খাচ্ছে। দূরে কোথায় যেন আপনমনে শিস দিয়ে চলেছে একটা দোয়েল। এক জায়গায় এসে দেখলো, খেজুর গাছে কলসি পাতছে ওদেরই বয়েসী একটা ছেলে।
কলসিতে যে মিষ্টি রস পড়ে, ইতিমধ্যে তা জেনে গেছে মুসা। কচিকে জিজ্ঞেস করলো, কখন খাওয়া যাবে?
সকালে, জানালো কচি।
সকালে কেন?
সারারাত ধরে কুয়াশা পড়বে। কুয়াশা আর রস গিয়ে জমা হবে কলসিতে। সকালে ওগুলো নামিয়ে বেচতে নিয়ে যাবে কৃষক।
ও। সকালে আসাই ভালো ছিলো তাহলে।
কেন, রস খাওয়ার জন্যে? হাসলো কচি। বেশ, আসবো একদিন সকালে।
গাছের ওপর থেকে ওদের কথাবার্তা সবই শুনেছে কৃষকের ছেলেটা। মুসার ভাঙা বাংলা বুঝতেও অসুবিধে হয়নি। স্থানীয় ইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে সে।
কলস পাতা শেষ করে নিচে নামলো ছেলেটা। তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। মুসা আর রবিনের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতে লাগলো সে। বুঝতে পারছে, বিদেশী। কচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনেরা কি এখানে নতুন আইলেন?
আমি পুরানোই। এরা নতুন।
ইনিও? কিশোরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।
হ্যাঁ।
কই থাকেন ভাই আপনেরা? এবারের প্রশ্নটা কিশোরকে।
আমেরিকায়। আমার নাম কিশোর পাশ, হাত বাড়িয়ে দিলো সে। ওরা আমার বন্ধু। ওর নাম মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড।
চকচক করে উঠলো ছেলেটার দুচোখ। দৃষ্টিতে বিস্ময় মেশানো অবিশ্বাস। রাখেন, রাখেন, আপনেদের নাম শুনছি! রকি বীচে থাকেন না আপনেরা?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালে কিশোর। চোখে কৌতূহল।
বুঝেছি, আপনেরাই! কতো পড়ছি আপনেগো কিচ্ছা! খুব ভাল লাগে আমার। আপনেরা তিন গোয়েন্দা, ঠিক কইলাম না? বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই কিশোরের হাত দুই হাতে চেপে ধরলো সে। আমার নাম আবদুল করিম। হগগলে ডাকে করিম কইয়া। খালি বাবায় আর হেডস্যারে যখন বেশি রাইগ্না যায়, তখন কয় করিম্মা। নিষ্পাপ হাসি হাসলো সে। এক এক করে মুসা আর রবিনের হাতও ন্টঝাঁকিয়ে দিলো।
ছেলেটার সরলতায় মুগ্ধ হয়ে গেল মুসী আর রবিন। আমেরিকায় এই বয়েসী কোন ছেলের এতোখানি আন্তরিকতা কল্পনাও করা যায় না।
মুসা জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের কথা জানো?
হ জানি, আবার হাসলো ছেলেটা। আপনে খালি খাইছে খাইছে করেন না? আর হগল সময় খালি খাওনের লাইগ্যা পাগল হইয়া থাকেন। ভূতের নাম শুনলেই কাছার কাপড় ফালাইয়া দৌড়। ঠিক না?
হ্যাঁ, ছেলেটার সব কথার অর্থ বুঝতে পারছে না মুসা, তবে মানে মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারছে।
গাছের মাথায় থাইক্কাই শুনলাম, রস খাওনের কতা কইতাছেন। অখন তো। অইবো না, বাই, সকালের আগে রস পাওন যাইবো না।
খুব সহজেই ওদেরকে আপন করে নিলো ছেলেটা। বকবক করে চললো। কাছেই ওদের বাড়ি। হাত তুলে দেখিয়ে দিলো।
সূর্য এখন আর চোখে পড়ে না। ডুবে গেছে। কিন্তু তার রেশ ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিম আকাশে সাদা মেঘের ছোট-বড় পাহাড়গুলো এখন রক্তলাল।
ওদেরকে তার বাড়িতে রাতের খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে বসলো করিম। আজ না, আরেক দিন, বলে অনেক কষ্টে এড়ানো গেল।
দ্রুত কমে আসছে গোধূলির কালচে সবুজ আলো। ছায়াঢাকা মেঠোপথ ধরে আবার শহরের দিকে ফিরে চললো ওরা। এক অপূর্ব আনন্দে মন ভরে গেছে। সবারই, বিশেষ করে তিন গোয়েন্দার।
মনে মনে আরেকবার স্বীকার করতে বাধ্য হলো রবিন আর মুসা, বাংলাদেশটা সত্যিই সুন্দর সুন্দর এর মানুষগুলো!
.
০৪.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ঘর থেকে বেরোতেই মামীর সঙ্গে দেখা। মুসার। তাকে ডাকতেই আসছিলেন তিনি। বললেন, উঠেছে। বারান্দায় গিয়ে দেখো কে এসেছে।
কে?
গিয়েই দেখো না, মিটিমিটি হেসে চলে গেলেন তিনি।
ভীষণ কৌতূহল হলো মুসার। চলে এলো বারান্দায়। তাকে দেখেই হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা।
আরে, করিম।
হ। রস লইয়া আইছি। আইজ রাইতে কুয়াশা খুব ভালো পড়ছিলো। ভালো। রস অইছে। সামনে রাখা দুই কলস রস দেখালো করিম। যান, একটা গেলাস লইয়া আয়েন। ঢাইল্লা দেই, খান।