হু, গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো কিশোর, এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দেখা যাক, কি হয়!
.
০৩.
পরদিন সকালে বাগানে বসে রোদ পোহাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় ছুটতে ছুটতে এলো কচি। ভীষণ উত্তেজিত। এসেই ধপ করে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, একশো বেয়াল্লিশটা।
কি একশো বেয়াল্লিশটা? মুসা অবাক।
গাড়ি!
গাড়ি?
একশো বেয়াল্লিশটা গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে! রাত একটা পর্যন্ত টেলিফোন এসেছে। ভোর থেকে শুরু হয়েছে আবার!
একশো বেয়াল্লিশটা! বিড়বিড় করলো কিশোর।
হ্যাঁ, কচি বললো। প্রথমটা ভেঙেছে দুই মাস আগে। আমাদেরটা ভাঙারও আগে।
তাহলে কিশোরের ধারণাই ঠিক, রবিন বললো। শুধু তোমাদের গাড়ির পেছনেই লাগেনি লোকটা।
সব কি ঢাকা শহরেই ভেঙেছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কচি।
কোন কোন এলাকার গাড়ি জিজ্ঞেস করেছিলে?
করেছি। ঠিকানাও লিখে নিয়েছি, বলে পকেট থেকে নোটবুক বের করলো। কচি।
সেটা নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে লাগলো কিশোর। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে বললো, চলো ঘরে যাই। দেখি, মামার কাছে ঢাকা শহরের কোনও ম্যাপ আছে। কিনা।
না থাকলেও অসুবিধে নেই। জোগাড় করে নেয়া যাবে।
স্টাডিতে পাওয়া গেল চৌধুরী সাহেবকে। একটা গোয়েন্দা গল্পের পেপারব্যাক পড়ছেন। মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই যে গোয়েন্দারা, কি খবর?
বললো কিশোর।
ম্যাপ পাওয়া গেল। বেশ বড় একটা। সেটা নিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো। কিশোর, বন্ধুদেরকে সঙ্গে নিয়ে।
আরিফ সাহেব জানতে চেয়েছেন ম্যাপ দিয়ে কি করবে কিশোর। বলেনি সে শুধু বলেছে, আগে কাজটা শেষ হোক, তারপর সব জানাবে। তিনিও আর জানার জন্যে চাপাচাপি করেননি। মুচকি হেসে শুধু বলেছেন, একেবারে এরকুল পোয়ারো।
তাঁর সঙ্গে একমত রবিন। আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা গল্পের নায়ক এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে স্বভাবের অনেক মিল আছে কিশোর পাশার।
ঘরে এসে ম্যাপটা টেবিলে বিছাতে বিছাতে কিশোর বললো, কচি, ধারে কাছে ভালো স্টেশনারি দোকান আছে?
কেন?
কয়েক বাক্স পিন দরকার। ওই যে, যেগুলোর পেছনে রঙিন প্ল্যাস্টিকের বোতাম লাগানো থাকে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, যে কটা রঙে পাওয়া যায়, সব। লাগবে।
এখানে এই উত্তরায় তেমন দোকান…আচ্ছা, ঠিক আছে, না পেলে টঙ্গি থেকে নিয়ে আসবো। এখুনি লাগবে?
হ্যাঁ, এখুনি।
নিয়ে আসছি আমি।
আমরা আসবো?
দরকার নেই। দরজার দিকে এগোলো কচি।
টাকা নিয়ে যাও।
আছে আমার কাছে, বলে বেরিয়ে গেল কচি। ফিরতে অনেক দেরি করে ফেললো। জানালো, এখানে পাইনি। টঙ্গি যেতে হয়েছে। পিনের বাক্সটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো সে।
সবাইকে নিয়ে কাজে বসলো কিশোর। কচি যখন দোকানে গেছে, বসে থাকেনি সে। চৌধুরী সাহেবের নানা বিচিত্র জিনিসের গুদাম থেকে বড় একটুকরো চারকোণী প্লাইউড জোগাড় করে এনেছে। সেটার ওপর ম্যাপটা ছড়িয়ে টেপ দিয়ে আটকে নিয়েছে।
চার রঙের পিন এনেছে কচি। সবগুলো খুলে বসলো কিশোর। কচিকে বললো, তুমি নোটবুক দেখে এক এক করে ঠিকানা বলো।
বলতে লাগলো কচি। বাক্স থেকে পিন তুলে নিয়ে ঠিকানা মোতাবেক ম্যাপের গায়ে গাঁথতে লাগলো কিশোর। তাকে সাহায্য করলো রবিন আর মুসা।
সময় যে কোনদিকে দিয়ে কেটে গেল, খেয়ালই রইলো না ওদের। দুপুরের খাবার জন্যে যখন ডাকতে এলেন মামী, তখন টনক নড়লো মুসার। প্রচণ্ড খিদে টের পেলো। এই খিদে ভুলে এতোক্ষণ থাকলো কি করে ভেবে নিজেই অবাক হলো।
উত্তেজিত হয়ে আছে চারজনেই। খাবার টেবিলে খুব একটা কথা বললো না। ওরা। তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে আবার পিন গাঁথতে বসলো। আরও ঘণ্টাখানেকের খাটুনির পর শেষ হলো কাজ। হউফ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো কিশোর। বললো, দেখো তো, এবার কিছু বোঝা যায় কিনা?
ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকালো মুসা, পারছি। ঢাকা শহরের কোন কোন এলাকায় ভাঙছে, স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে এখন।
হ্যাঁ। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছো? কচি যখন ঠিকানাগুলো বলে যাচ্ছিলো, তারিখও বলতে বলেছিলাম। কোন তারিখে কোন দিন ভেঙেছে। কাঁচগুলো। শুধু সোম আর বুধবারে। অন্য কোনো বারে একটা কাঁচও ভাঙেনি।
ঠিক ঠিক! বলে উঠলো রবিন। আর কোনো বারের কথা লেখেনি কচি!
আরও একটা ব্যাপার, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বললো কিশোর, যে রাস্তায়ই ভাঙে, মাঝের দু-তিনটে করে গলি বাদ দিয়ে নেয়।
কেন দেয়? জানতে চাইলো মুসা।
সেটা এখনও বলতে পারবো না। তবে জেনে যাবো।
গাড়ি নিয়ে আবার কি ফাঁদ পাততে যাচ্ছি আমরা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
নিশ্চয়ই। তবে আজ বিকেলে বেড়াতে যাচ্ছি, কিশোর বললো। তুরাগ নদীর ধার ধরে হেঁটে চলে যাবো গ্রামের ভেতর। যতদূর যেতে পারি। দূর থেকে দেখে মনে হয়, গ্রামগুলো সুন্দর। ভেতরে ঢুকে দেখতে চাই সত্যি কেমন।
নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা। তিন গোয়েন্দা আর কচি। শীতকাল। শুকনো মৌসুম। অনেক নিচে নেমে গেছে পানি। খুব ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। একেবেঁকে যাওয়া পানির স্রোত। রেললাইন পেরিয়ে হেঁটে চললো ওরা।
একপাশে ছড়ানো ফসলের খেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে সেই কবে, এখন খেত জুড়ে শুধু সাদা মাটির ঢেলা।
নদীর পাড়ে সাদা বালি, পানির ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। জায়গায় জায়গায় অসংখ্য শালিক বসে আছে। ঝগড়া বাধিয়েছে কোনো কোনোটা, কিচির মিচিয়ে কান ঝালাপালা। একখানে দেখা গেল পানির কিনারে এক পা তুলে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে সাদা বক। ওদের এগোতে দেখে ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল তার। চোখের পলকে ডানার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আরেকটা পা। সতর্ক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো ওদেরকে। বোধ হয় লক্ষ করছে হাতে এয়ারগান আছে কিনা। ইদানীং এই বয়েসী ছেলেরা বড় বেশি বিরক্ত করে। এই তো, দিন কয়েক আগেই মেরে নিয়ে গেছে তার সঙ্গিনীকে।