সামনের টায়ার ওকে হঠাৎ লাফ দিয়ে জানালার কাছে দুই পা তুলে দিলো। কুকুরটা। ওকে নামতে বললো মহিলা। নামলো না দেখে হাতের লাঠিটা তুলে শাই করে বাড়ি মারলো, তবে গায়ে লাগানোর জন্যে নয়, ভয় দেখানোর জন্যে। সেই সঙ্গে দিলো কড়া ধমক।
পা নামিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো কুকুরটা। মহিলা লাঠি হাতে চললো পেছনে।
মহা হারামী কুত্তা! মুসা মন্তব্য করলো।
আচ্ছা, রবিন বললো, কুকুরটাকে মারতে গিয়েই জানালার কাঁচে বাড়ি লাগিয়ে দেয়নি তো মহিলা?
মাথা নাড়লো কিশোর। না।
মহিলা চলে যাওয়ার পর পরই এলো দুটো ছেলে। একজনের হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট, আরেকজনের হাতে বল। বলটা বার বার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিচ্ছে। এগোচ্ছে ওভাবেই। গাড়ির কাছে পৌঁছে হাত ঘুরিয়ে ক্রিকেট বল যে ভাবে ছেড়ে তেমনি ভাবে জানালার কাঁচ সই করে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করলো ছেলেটী। কিন্তু মারলো না।
ছেলে দুটো পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর মুসা বললো, কিশোর, ওরা শয়তানী করে ভাঙেনি তো? বল ছুঁড়ে, কিংবা ব্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে?
না, আবার মাথা নাড়লো কিশোর, তা-ও মনে হয় না।
ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর আবার নীরব হয়ে গেল গলি। সময় যাচ্ছে। বাড়িঘরের অনেক জানালার আলোই নিভে যাচ্ছে একে একে। এক ঘণ্টা পেরোলো। এই সময়টায় একেবারে নির্জন রইলো গলিটা। তারপর এলো। লোকটা। লম্বা। মোড়ের দিক থেকে শাঁ শাঁ করে ছুটে এলো একটা টেন-স্পীড সাইকেলে চড়ে।
সতর্ক হয়ে উঠলো গোয়েন্দারা। সাইকেলের আলোটা বেশ উজ্জ্বল, টর্চের আলোর মতো এসে পড়েছে সামনের পথে। আঁটোসাঁটো পোশাক পরেছে। লোকটা, সাইকেল চালানোর সময় স্পোর্টসম্যানেরা যে রকম পরে। বিচিত্র আরও কিছু জিনিস রয়েছে তার শরীরে। পিঠে বাঁধা ব্যাকপ্যাক, মাথায় টুপি-ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা যে রকম পরে, চোখে বিচিত্র গগলস-গোল গোল কাঁচ, কানে। হেডফোন-ওয়াকম্যান কিংবা রেডিওটা দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় পিঠের ব্যাগের ভেতরে ভরে রেখেছে।
খাইছে! হেসে ফেললো মুসা। ব্যাটাকে দেখে তো মনে হয় ভিনগ্রহ থেকেই নেমেছে। হাহ্ হাহ্! স্টার ট্রেক ছবির দৃশ্য। টুপির বদলে মাথায় হেলমেট থাকলেই হয়ে যেতো।
গাড়িটার কাছে এসে গতি ধীর করলো লোকটা। দম বন্ধ করে ফেললো। ছেলেরা। মুখ এদিকে, যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মনে হলো, এখুনি কিছু ঘটবে। কিন্তু ঘটলো না। ওদেরকে নিরাশ করে আবার গতি বাড়িয়ে দিলো। লোকটা। ঢুকে পড়লো গিয়ে সামনের আরেকটা উপ-গলিতে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মুসা বললো, আমি তো মনে করেছিলাম…
এই ব্যাটাই কাঁচ ভাঙবে, বাক্যটা শেষ করে দিলো রবিন। অন্তত কিছু একটা করবে বলে মনে হচ্ছিলো আমার।
অন্ধকারে বসে ভ্রূকুটি করলো কিশোর, সেটা দেখতে পেলো না কেউ। আসলে সবাইকেই সন্দেহ করছি তো আমরা, ফলে নিরাশ হতে হচ্ছে। ধৈর্য ধরতে হবে।
বসে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঝাড়া। দিয়ে আবার স্বাভাবিক করে নিলো ওরা। অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলো কিশোর। এক ঘন্টা থাকার কথা, যে কোনো মুহূর্তে এখন বেরিয়ে আসতে পারে কচি।
হঠাৎ একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো কিশোরের। দূরের একটা কোণ থেকে ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে আসছে একজন মানুষ।
আরও কাছে এলে দেখা গেল মানুষটা ছোটখাটো, হাতে কি যেন রয়েছে।
হাতে কি? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।
এগিয়েই আসছে লোকটা, গাড়ির দিকে। মাঝে মাঝে পেছনে আর এদিক ওদিক ফিরে তাকাচ্ছে। যেন ভয় পাচ্ছে কোনো কারণে। হাতে একটা ছড়ি।
লাঠি! বেশ জোরেই বলে ফেললো রবিন, উত্তেজনায় আস্তে বলার কথা ভুলে গেছে।
ছড়ি দোলাতে দোলাতে গাড়ির দিকে আসছে লোকটা। ওটার একটা মাত্র বাড়ি লাগলেই চুরমার হয়ে যাবে জানালার কাঁচ।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ছেলেরা।
এগিয়ে আসছে লোকটা..আসছে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে…এবার একটামাত্র বাড়ি…কিন্তু না, পাশ কাটাচ্ছে সে, দ্রুত এগিয়ে চলেছে যেন তাড়া খেয়ে। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল মোড়ের অন্ধকারে।
হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো মুসা।
হতাশ অন্য দুজনও হয়েছে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের নির্জন, নীরব পথের দিকে। আর কেউ আসছে না। কোনো গাড়িও না। এগারোটা বাজলো, তার পরেও কিছু ঘটলো না।
এগারোটায় কচির বাড়ি ফেরার কথা, মনে করিয়ে দিলো মুসা।
সে-ও নিশ্চয় আমাদেরই মতো অপেক্ষা করছে, রবিন বললো, কাঁচ ভাঙার। বেরোচ্ছে না সেজন্যেই।
কিন্তু আর দেরি করে লাভ নেই, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। আজ আর ভাঙবে বলে মনে হয় না। চলো।
ঝোঁপের আড়াল থেকে পথে বেরিয়ে এলো ওরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো কচি। সবাই জড়ো হলো গাড়ির কাছে।
বিষণ্ণ কণ্ঠে কিশোর বললো, হয়তো আমার ধারণা ভুল।
ভুল? কি ভুল? জানতে চাইলে রবিন।
ভেবেছিলাম, কচির বন্ধুর গাড়িরও যখন একটা কাঁচ ভেঙেছে, তারমানে শুধু। কচিদেরটাই নয়, অন্য গাড়ির ওপরও চোখ আছে লোকটার, কাঁচ যে ভাঙে। কিন্তু। এখন মনে হচ্ছে, কোনো কারণে শুধু পিকআপটার ওপরই নজর। দেখা যাক আরও খোঁজ নিয়ে।
তাহলে আবার কাল এসে পিকআপের ফাঁদ পাতলেই পারি, মুসা পরামর্শ দিলো।
ভূত-থেকে-ভূতে কোনো কাজ দিচ্ছে না, রবিন বলে। অন্য গাড়ি কাঁচই যদি না ভাঙা হয়, কি খবর আসবে?