আবার হাসলেন মহিলা। আয়, খেতে আয়। কচি, তুমি যাওনি তোমার আব্বার সঙ্গে?
না, রাগ করে বললো কচি। ওই গাড়িতে আর উঠবো না। বাসে যাবো বলে রয়ে গিয়েছিলাম, ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল
ভালো হয়েছে। এসো, তুমিও এসো খেতে।
এই পরিবারের সঙ্গে মোটামুটি ভালোই খাতির জমিয়ে ফেলেছে কচি। মহিলার ছেলেমেয়ে এখানে কেউ নেই। এতো বড় বাড়িতে একা একা থাকেন শুধু স্বামীকে নিয়ে। ছেলেমেয়ের বয়েসী কাউকে পেলেই দ্রুত আপন করে নেন।
বিনা প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালো কচি। জানে খাবো না বলে লাভ হবে না, তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না নাদিরা খালাম্মা।
মামী যেমন দিলখোলা, হাসিখুশি, মামা তেমনি গম্ভীর। চাকরি করতেন পুলিশে, বড় অফিসার ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। সময় কাটানোর জন্যে সারাক্ষণই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রচুর বই পড়েন, বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প। কিশোরকে তার খুব পছন্দ। সুযোগ পেলেই বলে দেন, দেখ ইয়াং ম্যান, চাকরিই যদি করো, তাহলে পুলিশের। এর বাড়া চাকরি নেই। আর যেহেতু তুমি গোয়েন্দা, রহস্য পছন্দ করো, পুলিশ না হয়ে আর কি হবে? কোথায় গিয়ে আর গোয়েন্দাগিরি করার এমন সুযোগ পাবে?
কথাটা তিনি ঠিকই বলেন, মেনে না নিয়ে পারে না কিশোর। গোয়ন্দাগিরি করতে হলে পুলিশ হওয়াই উচিত। আমেরিকায় অবশ্য শখের গোয়েন্দা সে হতে। পারে, তবে পুলিশের চাকরিতে থেকে এই কাজ করার সুযোগ সুবিধে অনেক বেশি।
খাবার টেবিলে খেতে বসলো সবাই। মাথার কাছে বসেছেন চৌধুরী সাহেব। পুরু পুলিশী গোফ। চোখের দৃষ্টি এতো তীক্ষ্ণ, সরাসরি তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে মুসা, মনে হয় ধারালো ছুরির ফলা তার মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে ফালাফালা করে চিরে দেখছে কিছু লুকানো রয়েছে কিনা।
কচিকে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে দেখে মুচকি হেসেছেন পুলিশের ভূতপূর্ব ডি আই। জি। মামী প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়াতক অপেক্ষা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কি হে গোয়েন্দারা, রহস্য পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে?
মনে হয়, জবাব দিলো কিশোর।
কাঁচ ভাঙার রহস্য তো? আমার কাছেও কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে।
লাগছে, নী? পর পর চারবার একই গাড়ির কাঁচ ভাঙলো। কাউকে গাড়ির কাছে দেখা গেল না। কি করে ভাঙলো, কিছু বোঝা গেল না। অদ্ভুত ব্যাপার!
আলাপটা পরেও করতে পারবি, মুসার প্লেটে চিঙড়ির বিশাল দুটো কাটলেট তুলে দিয়ে বললেন মামী, আগে খেয়ে নে।
হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে এলো খাওয়া।
ইয়া বড় পুডিঙের অর্ধেকটাই মুসার পাতে দিয়ে দিলেন মামী। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল আনতে গেলেন।
হ্যাঁ, কাঁচ ভাঙার কথা হচ্ছিলো, কথাটা আবার তুললেন মামা। একই গাড়ির কাঁচ…
আলট্রাসনিক ওয়েভস! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। শব্দ কাঁচ ভাঙতে পারে।
ঠিক! পুডিঙের চামচ মাঝপথেই থেমে গেল মুসার। জেট প্লেনের শব্দে জানালার কাঁচ ভেঙে যেতে দেখেছি আমি!
এদেশে ওরকম প্লেন আসে না, বললেন চৌধুরী সাহেব। গাড়ি রেখেছিলে যেখানে, তার কাছাকাছি এমন কোনো কারখানা আছে, যেটার যন্ত্রপাতি থেকে। আলট্রাসোনিক ওয়েভ বেরোতে পারে?
না, মাথা নাড়লো কচি।
ভূমিকম্প নয় তো? মুসার প্রশ্ন।
এটা ক্যালিফোর্নিয়া নয়, মনে করিয়ে দিলো কিশোর। এখানে এতো জোরে ভূমিকম্প হয় না যে গাড়ির কাঁচ ভাঙবে।
বাতাস? রবিন বললো। ঝড়টর তো হয় এদেশেও। ঘূর্ণিঝড়?
নাহ, ওসব না।
কোনো ধরনের রশ্মি? মুসা বললো। বুঝেছি বুঝেছি, ডেথ রে!
স্টার ওয়ারস ছবিতে যেমন দেখায়? কচি বললো। হীট রে কিংবা ফোর্স রে?
অসুবিধে কি? রবিন বললো। বাংলাদেশে কি স্পেস শিপ নামতে পারে না?
নিশ্চয়ই! চামচ রেখে দিয়ে টেবিলে চাপড় মারলো মুসা। ভিনগ্রহ থেকে আসা!
অতি বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর কাজ বলে ভাবছো? কচি বললো।
কিংবা…কিংবা… ভয়ে ভয়ে উজ্জ্বল রোদে আলোকিত জানালার দিকে তাকালো মুসা, ভূত-টুত!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে জার্মান ভূত, পোলাটারগাইস্ট। বিরক্ত হয়ে বললো কিশোর। হাত নেড়ে বললো, কি সব ফালতু বকবকানি শুরু করেছো! থামো! মামার দিকে তাকিয়ে দেখলো, তাঁর সদাগম্ভীর মুখেও এখন যেন চিরস্থায়ী হাসি ফুটেছে, খুব উপভোগ করছেন তিনি। ভূত, স্পেস শিপভিসিআর সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছে!
তাহলে তোমার কি ধারণা? কিশোরের কথার ধরন পছন্দ হলো না কচির রবিন আর মুসার মতো কিশোরের কড়া কথার সাথে অভ্যস্ত নয় সে।
হ্যাঁ, স্পেস শিপ না হলে কি? রবিনের প্রশ্ন।
আমি বলে দিয়েছি, ভূত, ব্যস, হাত নাড়লো মুসা।
তোমার মাথা, কিশোর বললো। অবাস্তব সব কথাবার্তা। যুক্তিতে এসো। সহজ কোনো ব্যাখ্যা আছে এই কাঁচ ভাঙার। যেটা এখনও জানি না আমরা। জানতে হলে এখন দুটো কাজ করতে হবে।
কী? আগ্রহের সঙ্গে মুখ তুললো কচি।
আড়চোখে কিশোর দেখলো, মামার তীক্ষ্ণ চোখ দুটোও এখন তার ওপর নিবদ্ধ, সে চোখে কৌতূহল।
মামা, তোমার গাড়িটা ধার দেবে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। রাতের বেলা?
কেন?
ওটা দিয়ে ফাঁদ পাতবো। পথের মোড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবো…।
কেউ কাঁচ ভাঙে কিনা দেখার জন্যে? কিশোরের কথাটা শেষ করে দিলেন মামা। বুদ্ধিটা মন্দ না। দেবো। যদিও রিস্কি হয়ে যায় ব্যাপারটা। আর দ্বিতীয় কাজ কি?
ভূত-থেকে-ভূতে।