অবাক হয়ে কিশোরের কথা শুনছেন ওসি সাহেব। ছেলেটার কিছু কিছু কথা বুঝতে পারছেন না। এই যেমন ভূত-থেকে-ভূতে। তবে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিশোরের কথা থেকে আন্দাজ করে নেয়ার অপেক্ষায় আছেন।
ওরা কি একসঙ্গে কাজ করতো? রবিন জানতে চাইলো। মানে, পার্টনার?
মাথা নাড়লো কিশোর। না। রনটুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি, ঠিক বলিনি?
মাথা নেড়ে সায় জানালো রনটু।
পার্টনার না হলে, আবার জিজ্ঞেস করলো রবিন, তাকে হুঁশিয়ার করতে গেল কেন দ্বিতীয় লোকটা?
এ তো সহজ কথা, হাত ওল্টালো কিশোর। রনটু ধরা পড়লেই পুলিশ জেনে যাবে ঈগলটা সে চুরি করেনি। আসল চোরকে খুঁজতে শুরু করবে তখন। সেই ভয়েই তাকে ওয়্যারলেসে হুশিয়ার করে দিয়েছে চোর যে, তার ওপর সন্দেহ পড়েছে। প্রমাণ খোঁজা হচ্ছে। ব্যস, তাড়াতাড়ি এসে সেগুলো সরানোর চেষ্টা। করেছে রনটু। তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, তাই না?
আবার মাথা ঝাঁকালো, রনটু। তাজ্জব হয়ে গেছে, তার চোখ দেখেই অনুমান করা যায়।
কে করেছে, নিশ্চয় জানেন না?
না।
ওসি সাহেব বললেন, তাহলে ধরে নেয়া যাচ্ছে, আরেকজন আছে। কে, জানো নাকি? ধরতে পারবে?
সরাসরি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বললো, ইলেকট্রনিকসে তার। অসাধারণ জ্ঞান। মনে হয় ধরতে পারবো। আজ বিকেলেই। যদি আমাকে সাহায্য করেন।
কিশোরের ওপর বিশ্বাস জন্মে গেছে ওসি সাহেবের। তবু দ্বিধা করলেন। আরিফ সাহেবের দিকে তাকালেন একবার। তারপর বললেন, বেশ, করবো। শরাফত আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সরি, শরাফত সাহেব, আপনার ছেলেকে থানায় নিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। জামিন চাইলে হয়তো পাবেন। উকিলের সঙ্গে কথা বলুন।
গম্ভীর হয়ে বললেন শরাফত আহমেদ, নিয়ে যান। যে ছেলে বাপের নাক-কান কাটে, তাকে ছাড়িয়ে আনতে যাচ্ছি না আমি।
কিন্তু আব্বা, মরিয়া হয়ে বললো রনটু, তুমি বুঝতে পারছে না, ব্যবসার উন্নতির জন্যেই আমি একাজ…
ব্যবসার উন্নতির জন্যে এসব করতে বলা হয়নি তোমাকে! কড়া গলায় বললেন শরাফত সাহেব। ওসি সাহেব, নিয়ে যান। যা শাস্তি হয় তোক। ওর শাস্তি হওয়াই উচিত। বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। চোখের কোণে জল।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আরিফ সাহেব। আস্তে বললেন, জীবনে কতো যে ঘটনা দেখলাম! সন্তান মানুষ না হলে… কথাটা শেষ করলেন না তিনি। কিশোরের দিকে তাকালেন, তা চোরটা কে, বললি না তো?
ডলি খান, বোমা ফাটালো যেন কিশোর। মিস্টার আকবর আলি খানের মেয়ে।
.
১৭.
কিশোরের ওপর ভীষণ রেগে গেল ডলি। আকবর সাহেরে বসার ঘরে বসেছে সবাই-আকবর সাহেব, তাঁর মেয়ে ডলি, তিন গোয়েন্দা, কচি, ওসি সাহেব, আরিফ সাহেব। রনটুকে নিয়ে পুলিশের জীপে করে থানায় চলে গেছেন সার্জেন্ট আজিজ।
কাজটা আপনিই করেছেন, শান্তকণ্ঠে আবার বললো কিশোর। আরো আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমার।
কিন্তু একাজ কেন করবে আমার মেয়ে? হাতের লাঠিটা সজোরে মেঝেতে ঠকলেন আকবর সাহেব।
আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করুন।
না, আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
আসলে মেয়ের কোনো খোঁজখবর রাখেন না তো আপনি, আছেন নিজেকে নিয়ে আর আপনার মুদ্রা নিয়ে, নইলে অনেক আগেই বুঝতে পারতেন। কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই বললো কিশোর। আকবর সাহেবের দুর্ব্যবহার অনেক সহ্য করেছে সে, আর নয়। ডলির দিকে তাকিয়ে বললো, দয়া করে আপনার কামিজের হাতাটা একটু তুলবেন?
রেগে গেলেন আকবর সাহেব। কেন, কামিজের হাতা তুলবে কেন? ফাজলেমি করার আর জায়গা পাওনি!
আমি ফাজলেমি করছি না। তুলতে বলুন, নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।
কি দেখতে পাবো?
আগে তো তুলুক।
কিন্তু দ্বিধা করতে লাগলো ডলি।
কি হলো? ডলির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো কিশোর। তুলুন।
ধীরে ধীরে ডান হাতের হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটালো ডলি। চোখ নামিয়ে রেখেছে। তার হাতের কালো কালো দাগগুলো সবাই দেখলো। সবাই বুঝতে পারলো কিসের দাগ ওগুলো, শুধু কচি আর আকবর সাহেব ছাড়া। তিনি বললেন, তুললো তো, এখন কি হলো?
ধৈর্য হারালেন ওসি। আকবর সাহেবের কাটা কাটা কথা তারও পছন্দ হচ্ছে না। কঠিন কণ্ঠে বললেন, কেন, বুঝতে পারছেন না?
না, পারছি না! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন আকবর সাহেব।
আরিফ সাহেব বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে আপনার মেয়ের, জানেনই না আপনি! ও ড্রাগ অ্যাডিক্ট। সর্বনাশা নেশার জালে জড়িয়ে পড়েছে আপনার মেয়ে। ওগুলো ইঞ্জেকশনের সুচের দাগ।
হঠাৎ যেন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন আকবর সাহেব। এলিয়ে পড়লেন। সোফায়। বোকার মতো চেয়ে রয়েছেন মেয়ের হাতের দাগগুলোর দিকে। স্তব্ধ হয়ে গেছেন।
এবার কি আর অস্বীকার করবেন, ডলির দিকে চেয়ে কোমল গলায় বললো কিশোর, হেরোইন কেনার টাকার জন্যে ঈগলটা চুরি করেননি আপনি?
জবাব দিলো না ডলি। মাথাটা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর।
আমেরিকায় গিয়ে এই নেশার শিকার হয়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো ডলি। পড়তে গিয়েছিলাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এই সর্বনাশ হয়েছে আমার। আব্বা টাকা পাঠাতে পড়ার জন্যে, আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে খরচ করতাম নেশার পেছনে। তাতেও কুলাতো না। নানান অসুবিধায়। পড়লাম। শেষে বাধ্য হয়ে চলে এসেছি দেশে।
ইলেকট্রনিকসে আপনার অসাধারণ জ্ঞান। ওই স্যাটেলাইট ডিশটা আপনারই, তাই না?