চত্বরে ঢুকলো পুলিশ। এই সময় অফিসের কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়েসী মানুষটা। এঁকেই কাঁচে ঘেরা ছোট অফিসে একলা বসে থাকতে দেখে কিশোর আর কচি। নাকমুখ কুঁচকে ভারি গলায় জানতে চাইলেন, কি হয়েছে?
আপনি? পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
আমি শরাফত আহমেদ। এই কোম্পানির মালিক।
ও। একে চেনেন?
চিনবো না কেন? আমার ছেলে, রনটু। কি করেছে ও?
টেন-স্পীডটা ঠেলে নিয়ে এসেছে একজন কনস্টেবল। সেটা দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন ওসি, এই সাইকেলটা কি আপনার ছেলের? আর এই ক্যাপ, চশমা…
আব্বা, বলো না, বলো না, কিছু বলো না! চেঁচিয়ে বাধা দিলো রনটু।
ছেলের দিকে অবাক হয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন শরাফত আহমেদ। তারপর ওসির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন, হ্যাঁ, ওরই। কেন? ব্যাপারটা কি? কি করেছে ও?
বাবার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো ছেলে। তার মুখের দিকে চেয়ে কি বুঝলেন শরাফত সাহেব, কে জানে। হাত নেড়ে সবাইকে ডাকলেন, ভেতরে আসুন। বসে কথা বলি।
শরাফত সাহেব, আরিফ সাহেব বললেন, শুনলে দুঃখ পাবেন। আপনার ছেলে যে কাজ করেছে… এয়ার পিস্তল দিয়ে কিভাবে একের পর এক গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে খুলে বললেন তিনি।
গাঙির কাঁচ ভেঙেছে! বিড়বিড় করলেন শরাফত আহমেদ। হু, বুঝতে পারছি, কেন করেছে এই কাজ। দুঃখের সুরে বললেন তিনি, কলেজে দিয়েছিলাম। পড়ালেখা করলো না। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে বখে গেল। ভাবলাম, এনে ব্যবসায় লাগিয়ে দিই। কিছু দিন কিছুই করলো না। রেগেমেগে শেষে একদিন। হুঁশিয়ার করে দিলাম, ঠিকমতো কাজ দেখাতে না পারলে বাড়ি থেকেই বের করে। দেবো। সম্পত্তির একটা কানাকড়িও দেবো না। তারপর হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। গত তিনমাস ধরে তো চমৎকার কাজ দেখাচ্ছিলো। সেলস ম্যানেজার বানিয়ে দিয়েছিলাম। এমন ভাবে গাড়ির কাঁচ বিক্রি শুরু করলো, আমি তো ভাবলাম… হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, অথচ…এই কাজ করেছে! নিজেই গাড়ির কাঁচগুলো ভেঙে দিয়ে এসেছে, যাতে মালিকেরা কিনতে বাধ্য হয়। ইস্, রনটু, তুই এভাবে আমার মুখে চুনকালি মাখালি…,
ওদের কথা বিশ্বাস করো না, আব্বা! প্রতিবাদ করলো রনটু। কি বলছে তাই বুঝতে পারছি না। ওরা শত্রুতা করছে আমার সঙ্গে, তিন গোয়েন্দাকে দেখালো সে। আমার জিনিসগুলো চুরি করে নিয়ে গাড়িতে ভরে রেখেছে আমাকে ফাসানোর জন্যে! প্রমাণ করতে পারবে আমি ভেঙেছি? কেউ দেখেছে?
পারবো! জোর দিয়ে বললো রবিন। চোরাই ঈগলটা খুঁজে পেলেই হয়।
চোখ মিটমিট করলেন শরাফত আহমেদ। চোরাই ঈগল! ঈগল পাখিও চুরি করেছে!
পাখি নয়, ব্যাখ্যা করলো কচি, একটা দুর্লভ মুদ্রা। উনিশশো নয় সালে তৈরি। একটা আমেরিকান বিশ ডলারের সোনার মোহর, ডাবল ঈগল বলে ওটাকে। গাড়ির জানালা ভেঙে চুরি করেছে ওটা আপনার ছেলে। অনেক দাম…
মোহর চুরি করেছে! শরাফত আহমেদের গলা কেঁপে উঠলো। আমার ছেলে চোর!
ফ্যাকাশে হয়ে গেছে রনটুর চেহারা। বললো, বিশ্বাস কোরো না, আব্বা! গলায় জোর নেই তার। এটাও আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। বেশ, স্বীকার করছি, গাড়ির কাঁচ ভেঙেছি আমি। কিন্তু কক্ষনো মোহর চুরি করিনি! খোদার কসম! আমাদের ব্যবসা খারাপ হয়ে গেছে, তাই বাড়াতে চেয়েছিলাম। বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মোহর আমি চুরি করিনি!
অনেকক্ষণ থেকেই একেবারে চুপ হয়ে আছে কিশোর। শুনছে কথাবার্তা। হঠাৎ এখন রনটুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠলো, না, আমারও বিশ্বাস, আপনি চুরি করেননি!
.
১৬.
কিশোরের কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল তার বন্ধুরা। প্রথমে কথা খুঁজে পেলো রবিন, ঈগলটা ও চুরি করেনি?
কিশোর? ভুরু কোঁচকালেন আরিফ সাহেব। ব্যাপারটা কি বল তো? তুই জানিস কে চুরি করেছে?
ধীরে ধীরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো কিশোর, আমি এখনও শিওর না।
শিওর না হলে বলা উচিত না।
ঈগলটা যে শরাফত সাহেরে ছেলে চুরি করেনি, এটা শিওর। কে করেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে চেষ্টা করলে হয়তো ধরে ফেলতে পারবো।
তারমানে তুই বলতে চাইছিস যে কাঁচ ভাঙে সে মোহর চোর নয়?
না। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে।
সেটা কি? অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা।
এ ধরনের অপরাধকেই বলে কপিক্যাট ক্রাইম, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর।
কি ক্রাইম! নাকমুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কচি।
বাংলা মানে বোধহয় করা যাবে না এর, কিশোরের হয়ে জবাবটা দিলেন আরিফ সাহেব। তবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একই সময়ে দুটো অপরাধ ঘটলো। আগে থেকেই ঘটছে এ রকম একটা অপরাধ আরও একবার ঘটলো। ঠিক ওই সময়ে আরেকজন অপরাধী আরেকটা অপরাধ ঘটালো। এমন ভাবে, যাতে মনে হয় দুটোই একজনের কাজ। দ্বিতীয় কোনো অপরাধী যে আছে এটা সহজে বোঝা যাবে না।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। গাড়ির কাঁচ ভাঙার খবরটা জানা ছিলো আমাদের এই দ্বিতীয় অপরাধীর। কাজেই সুযোগ বুঝে আকবর সাহেবের গাড়ির জানালা ভেঙে ঈগলটা চুরি করেছে সে। আশী করেছে, দোষটা গিয়ে পড়বে যে কাঁচ ভাঙে তার ঘাড়ে।
হ্যাঁ, এ রকম অপরাধ অনেক সময়ই ঘটে, এবার মুখ খুললেন ওসি সাহেব। কিশোরের বুদ্ধি, জ্ঞান আর কথাবার্তা রীতিমতো অবাক করেছে তাকে। কি করে বুঝতে পারলে সেটা?
সবার মুখের দিকে তাকালো একবার কিশোর। তারপর বললো, গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিলো, এই কেসে আরও একজন জড়িত রয়েছে। আড়িপেতে আমাদের কথা শুনেছে। কোন ভাবে আমাদের কথা জেনে গিয়েছিল সে, সে জন্যেই শুনতে চেয়েছে আমাদের কথা। টেলিফোন লাইনে ওয়্যারট্যাপ লাগিয়ে দিয়েছে। হুঁশিয়ার করে দিয়েছে রনটুকে যে সারা শহরে ভূত-থেকে-ভূতে চালু হয়ে গেছে, ভূতেরা শুরু করে দিয়েছে কাজ। ব্যাপারটা সম্পর্কে শিওর হতে পারতাম না আমি, যদি সে ছোট্ট একটা রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারতো। ভেবেছে আমাদের নিয়ে খানিকটা মজা করবে। ফোনে আমাদের খবর দিয়েছে যে কাঁচ ভাঙুরা ধরা পড়েছে। যা-ই হোক, আমাদের ঠকিয়েছে সত্যি, তবে ফাঁকিটাতে সে নিজেই পড়ে নিজেকে ফাস করে দিয়েছে।