নীল টয়োটার পেছনে ছুটলো পুলিশের জীপ। যেদিকে গেছে গাড়িটা, সে পথটা শেষ হয়ে গেছে খানিক দূর গিয়েই। তারপরে জলা। একপাশে ফসলের খেত। মাঝে মাঝে নতুন মাটি ফেলা হয়েছে বাড়ি তোলার জন্যে। উঁচু হয়ে আছে ভিটেগুলো।
জলার ধারে গিয়ে থেমে গেল গাড়ি। ভেতর থেকে কামানের গোলার মতো ছিটকে বেরোলো নীল জ্যাকেট পরা এক তরুণ। ভয়ার্ত চোখে একবার পুলিশের গাড়ির দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে গিয়ে নামলো খেতের মধ্যে। এঁকেবেঁকে দিলো দৌড়।
ধরো! ধরো! চেঁচিয়ে আদেশ দিলেন ওসি।
কিন্তু জীপ থামিয়ে পুলিশ নামার আগেই নীল গাড়িটা থেকে ছিটকে বেরোলে। আরেকজন। তাড়া করলো লোটাকে। মুসা আমান। নিয়মিত ব্যায়াম করা শরীর তার, তাছাড়া দৌড়াতে পারে খুব। লাফিয়ে ছুটলে খেতের ওপর দিয়ে। দ্রুত দূরত্ব। কমে আসছে দুজনের মাঝে। দৌড়ানোর অভ্যাস বোধহয় খুব একটা নেই তরুণের, তাছাড়া পায়ে রয়েছে চামড়ার জুতো। চষা-খেতের ওপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে। কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলো।
লোকটার কয়েক ফুট পেছনে থাকতেই মাথা নিচু করে ডাইভ দিলো মুসা। তার বিখ্যাত ফ্লাইং ট্যাক। কায়দাটার একটা গালভরা বাংলা নাম দিয়েছে কিশোরঃ উড়ুক্কু মানব বর্শা।
পিঠে যেন মুগুরের বাড়ি পড়লে তারুণের। মুসার ভীষণ শক্ত খুলির প্রচণ্ড আঘাতে হাত-পা ছড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে থেতের ওপর পড়ে গেল সে। পরমুহূর্তেই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে বসলো আবার। কিন্তু দাঁড়াতে পারলো না। তার এক পা আঁকড়ে ধরেছে মুসা।
গায়ের জোরে ঝাড়া দিয়ে পা-টা ছাড়িয়ে নিতে না নিতেই আরেক পা ধরে। ফেললো মুসা। হ্যাঁচকা টানে চিৎ করে ফেলে দিলো তাকে। লোকটা আবার উঠে বসার আগেই পৌঁছে গেল পুলিশ। ঘিরে ফেললো।
মাটির ওপরই পা ছড়িয়ে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে মুসা। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো সার্জেন্ট আজিজের ওপর চোখ পড়তে। হাত তুলে তরুণকে দেখিয়ে বললো, এই যে নিন আপনার কাঁচ ভাঙুরে।
দুদিক থেকে দুহাত চেপে ধরেছে পুলিশ। ঝাড়াঝুঁড়া দিয়ে ছাড়া পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো তরুণ। খেঁকিয়ে উঠলো, মিথ্যে কথা! আমি কিচ্ছু জানি না। আমাকে কেন ধরেছে! কিছুই করিনি আমি এই ব্যাটাই চুরি করতে। ঢুকেছিলো আমাদের গুদামে!।
হাসি মুছলো না মুসার মুখ থেকে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ওর গাড়িতে গিয়ে দেখুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন।
গালাগাল শুরু করলো তরুণ। তাকে জীপের দিকে টেনে নিয়ে চললো পুলিশ। ওখানে নীল টয়োটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রবিন।
গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেল ক্যাপ, চশমা, ব্যাকপ্যাক, তার ভেতরে রেডিও আর হেডফোন। সাইকেল চালানোর পোশাকগুলোও রয়েছে ব্যাগে। কিশোরের অনুমান। ঠিক, চশমাটা ফীল্ড গ্লাসই, চোখে লাগালে রাতের অন্ধকারেও সব দেখা যায়।
ওরা ইচ্ছে করে এগুলো আমার গাড়িতে ভরে রেখেছে। চেঁচিয়ে উঠলো তরুণ। আমাকে ফাসানোর জন্যে!
জিনিসগুলো যে আপনার, প্রমাণ করা যাবে সেটা, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। আপনার কোম্পানির লোকই সাক্ষী দেবে আশা করি। সাইকেলটা পড়ে আছে চত্বরে। সেটা আপনার, অফিসের সবাই জানে। ওটাতে, সিরিয়াল নম্বর রয়েছে। কোন দোকান থেকে কিনেছেন, সহজেই বের করা যাবে।
ওসবের দরকারই নেই আসলে, মুসা বললো। বড় প্রমাণটা রয়েছে ওর গাড়ির সামনের সীটের নিচে। ঢুকিয়ে রাখতে দেখেছি। এয়ার-পিস্তলটা। আঙুলের ছাপও পাওয়া যাবে তাতে।
চুপ হয়ে গেল তরুণ।
সীটের নিচ থেকে সাবধানে রুমালে চেপে ধরে পিস্তলটা ব্রে করে আনলেন ওসি। মোটা খাটো নল। নলের নিচে আরেকটা নলের মতো পাইপ। ওটায় চাপ দিয়ে ভেতরের স্প্রিংটাকে ভাঁজ করা যায়। ইস্পাতে তৈরি নীলচে চকচকে অস্ত্রটার ওজন বড়জোর দুই পাউণ্ড। খোদাই করে লেখা রয়েছে কোম্পানির নাম ও দি ওয়েবলি প্রিমিয়ার। তার নিচে অপেক্ষাকৃত ছোট অক্ষরে লেখা, মেড ইন ইংল্যাণ্ড।
হু, পয়েন্ট টু-টু ক্যালিবার, দেখতে দেখতে বললেন আরিফ মামা। এই জিনিস একটা ছিলো আমার। সাংঘাতিক শক্তি ম্প্রিঙের। কাছে থেকে গুলি করলে গাড়ির কাঁচ সহজেই গুঁড়িয়ে দেয়া যায়।
তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালেন ওসি সাহেব। তরুণকে দেখিয়ে পুলিশদের নির্দেশ দিলেন, নিয়ে এসো ওকে। শরাফত আহমেদের সঙ্গে কথা বলবো।
হাঁটতে হাঁটতে জানালো রবিন আর মুসা, কিভাবে গুদামের মধ্যে তরুণের ব্যবহার করা জিনিসগুলো খুঁজে পেয়েছে। কি করে সেগুলো নিয়ে পালানোর চেষ্টাটা করেছিল সে। মুসা বাধা দিতে গেলে কিভাবে তাকে পিস্তল দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়েছে।
পালাচ্ছে দেখে খেপে গিয়েছিলাম, কৈফিয়তের সুরে বললো মুসা। আসলে ওকে দেখে একটুও বিপজ্জনক লোক মনে হয়নি আমার। বরং মনে হচ্ছিলো খুব ভীতু। ধরার জন্যে বেরোলাম। এয়ার পিস্তল দেখিয়ে ঠেকালো আমাকে। গাড়িতে উঠতে বাধ্য করলো। চিনতে পেরেছি তখনি, ওটা এয়ার পিস্তল। জানি, ক্লোজ রেঞ্জে আসল পিস্তলের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি চালিয়ে সহজেই মানুষ মেরে ফেলা যাবে। কি আর করবো, উঠে বসলাম। গেট দিয়ে বেরিয়েই আপনাদের দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল ওর। দিলো আরেক দিকে টান।
হই চই, পুলিশের বাঁশি, সবই শুনতে পেয়েছে গ্লাস কোম্পানির লোকেরা। পাশের গেটের বাইরে বেরিয়ে জটলা করছে। পুলিশের সঙ্গে তরুণকে দেখে ভুরু কুঁচকে গেল কয়েকজনের। ওরা সবাই অফিসের কর্মচারী। একজন ফিরে দৌড় দিলো অফিসের দিকে।