ঝট করে ফিরে তাকালো কিশোর। সেলসম্যানদের একজন, সেই তরুণ লোকটা হেঁটে যাচ্ছে পাশের দরজার দিকে। গুদামে যাওয়ার চত্বরে বেরোনোর পথ। ওটা।
.
১৪.
কিশোরদেরকে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখলো মুসা আর রবিন। চত্বরে অপেক্ষা করলো আর মিনিট দুয়েক। কাউকে আসতে না দেখে দ্রুতপায়ে এগোলো গুদামের দিকে। নির্জন। কেউ নেই। মূল বাড়িটার পেছনে গুদামের দিকে মুখ করে রয়েছে। একটিমাত্র জানালা। দরজা আছে। সব বন্ধ।
আরেকবার এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে গুদামে ঢুকে পড়লো দুজনে।
ভেতরে অলৌ কম। জানালা নেই। দরজা দিয়ে যা আসছে তাতে ভেতরের অন্ধকার কাটছে না। ফলে সারাক্ষণ বৈদ্যুতিক আলো জ্বেলে রাখতে হচ্ছে। সারি। সারি তাক, ওগুলোতে নানা রকমের প্যাকেট আর বাক্স। মেঝেতে একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে স্কুপ করে রাখা হয়েছে ছোট-বড় কাঠের বাক্স। বাদামী কাগজে মোড়া অনেক কাঁচ,দেখা গেল একটা তাকে। কান পেতে রইলো কিছুক্ষণ দুজনে। নিশ্চিত হয়ে নিলো ভেতরে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই।
লম্বা শেলফগুলোর মধ্যে দিয়ে রয়েছে চলাচলের জন্যে সরু গলিপথ। সে পথে এগোলো ওরা। তাকের মধ্যে ফাঁক দেখলেই উঁকি দেয়, মাথা নিচু করে তাকায় শেলফের নিচের ফাঁকে। সাইকেলওয়ালার ব্যবহৃত জিনিসের চিহ্ন খুঁজছে।
কিছুই পাওয়া গেল না।
গুদামের শেষ প্রান্তে পার্টিশন দিয়ে ছোট একটা অফিস করা হয়েছে। তবে সেটা বোধহয় এখন আর অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। কারণ ওটার ভেতরেও বাক্স বোঝাই করে রাখা হয়েছে। অফিসের জিনিসপত্র রাখার একমাত্র কাঠের আলমারিটা এখন খালি। ব্যবসা বোধহয় খারাপ যাচ্ছে, লোক ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছে মালিক।
আবার গুদামের সামনের দিকে চলে এলো ওরী। ভেতরে আরও খুঁজে দেখার ইচ্ছে আছে। তবে তার আগে দেখে নিশ্চিন্ত হতে চায় যে কেউ আসছে না। আগের মতোই নির্জন চত্বর। সামনের গেট দিয়ে গাড়ি আসা-যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোন গাড়িই পাশের গেট দিয়ে ঢুকছে না।
কেউ নেই… বলতে গিয়েই থেমে গেল মুসা।
কি হলো! তার পাশে এসে দাঁড়ালো রবিন।
দুজনেই দেখতে পাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে মূল বিল্ডিং থেকে চত্বরে বেরোনোর দরজা।
.
তিন লাফে কাউন্টারের শেষ মাথায় চলে এলো কিশোর। ওদিকেই চত্বরে বেরোনোর দরজাটা। হাত নেড়ে ডেকে বললো, এই যে ভাই, শোনেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। আমার কথাটা খুব জরুরী।
আসছি, দরজা ঠেলে খুলতে খুলতে বললো লোকটা। বেশি দেরি হবে না।
এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, রেগে যাওয়ার ভান করলে কিশোর। কথা বলছেন তো বলছেনই। আমাদের কি চোখে পড়ে না? মালিক কে আপনাদের? তার সঙ্গে কথা বলবো।
দরজার হাতলে হাত রেখেই থমকে গেল সেলসম্যান। দ্বিধা করছে। এ রকম করে যখন কথা বলছে নিশ্চয় হোমড়া চোমড়া কারও ছেলে।
মালিক কে? কড়া গলায় আবার জিজ্ঞেস করলো কিশোর। হাত তুলে কাঁচের অফিসে একলা বসা মানুষটাকে দেখিয়ে বললো, উনি?…এই কচি, এসো, বাবার কথা গিয়ে বলি। বলবো, আমাদেরকে পাত্তাই দেয়নি আপনাদের সেলসম্যান।
চলো, কিশোরের অভিনয় দেখে মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না কচি।
যা বোঝার বুঝে গেল সেলসম্যান। এই ছেলেকে বেশি ঘাটানো উচিত হবে না। চাকরি চলে যেতে পারে তাহলে। দরজার হাতল ছেড়ে দিয়ে কাউন্টারের কাছে ফিলে এলো সে। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?
একটা রোলস রয়েসের কাঁচ, গম্ভীর মুখে বললো কিশোর। ভেতরে ভেতরে পেট ফেটে যাচ্ছে হাসিতে।
রোলস রয়েস! বিস্ময়ে ভুরু উঁচু হয়ে গেল সেলসম্যানের। এতো দামী গাড়ির কাঁচ পাবো কোথায়?
সেটা আমি কি জানি? বাবা বলে পাঠালো নিয়ে যেতে, নিতে এলাম।
কোন মডেলের? মড়েল জানলে বলতে পারবো। টয়োটার কোন কাঁচ ওটায় লাগে কিনা দেখা যেতে পারে।
ঊনিশশো সাইতিরিশ মডেলের সিলভার ক্লাউড, আমেরিকায় যে গাড়িটাতে চড়ে ওরা, হ্যাঁনসন চালায়, সেটার কথা বলে দিলো কিশোর।
মরা মাছের মতো হাঁ হয়ে গেল সেলসম্যানের মুখ। ঢোঁক গিললো। ফ্যাকাশে মুখে রক্ত ফিরতে সময় লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো, নামই শুনিনি। কখনও, দেখা দূরে থাক। গাড়িটা কি নিয়ে এসেছো?
আপনি করে বলুন, ঝাঝালো কণ্ঠে বললো কিশোর। তুমি শুনতে ভালো লাগে না আমার।…না, গাড়ি আনিনি।
তাহলে দয়া করে যদি ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও..মানে, দেন, তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি টয়োটার কাঁচ ফিট করে কিনা।
.
দরজা খুলতে দেখে বরফের মতো জমে গেছে রবিন ও মুসা। ওদের মনে হলো। অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা খেলা চত্বরে রোদের মাঝে, আর খুলেই চলেছে দরজাটা। এই খোলার যেন আর শেষ নেই।
তারপর ধীরে ধীরে আবার বন্ধ হয়ে গেল।
হাউফ! করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুসা।
এসো, তাড়া দিলে রবিন। জলদি ঢুকে পড়ি ওটায়। দুই নম্বর গুদামটা। দেখালো সে।
প্রায় দৌড়ে এসে দ্বিতীয় গুদামে ঢুকলো ওরা। এটার ভেতরটাও প্রথমটারই মতো অন্ধকার। আলো জ্বেলে রাখতে হয় সর্বক্ষণ। সারি সারিতাক। তবে তাকগুলোর বেশির ভাগই খালি।
প্রথম ঘরটার মতোই এটাতেও খুঁজতে শুরু করলো ওরা। এখানেও কিছু পেলো। না। আরেকবার এসে উঁকি দিলো দরজায়। কাউকে দেখা গেল না। মূল বাড়ি থেকে বেরোলো না কেউ। চত্বরে বেরিয়ে একছুটে এসে ঢুকলো তৃতীয় এবং সব চেয়ে– ছোট গুদামটায়। অন্য দুটোর মতোই এটাতেও আলো কম। কিছু মালপত্র রয়েছে কয়েকটা তাকে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার ওপর কাঁচ কাটার যন্ত্রপাতি। পাশে কয়েকটা লম্বা লম্বা টুলও রয়েছে। কাজ হয় ওগুলোতে।