তাকিয়েই রয়েছে ছেলেরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নিচের কাজকর্ম দেখছে। মূল। বাড়িটার মুখ রাস্তার দিকে নয়, ডানের পার্কিং লটের দিকে। বয়ে আরেকটা আছে, সেটাতে শুধু ট্রাক কিংবা ভ্যানগাড়ি ঢোকে, মাল বোঝাইয়ের জন্যে। আর ঢোকে খুচরা খরিদ্দার। নানা রকম গাড়ি আসছে যাচ্ছে সেখানে-পিকআপ, ভ্যান, কার। সব টয়োটা। এবং সবগুলোর কাঁচ ভাঙা।
দেখে তো মনে হয় পাইকারী বিক্রি করে এরা, মুসা বললো কিছুটা অবাক হয়েই। তাহলে ওই গাড়িগুলো আসছে কেন এতো বেশি?
শুধু পাইকারী বিক্রিতে বোধহয় চলছিলো না আর, জবাবটা দিলো কচি। খুচরাও শুরু করেছে।
মূল বাড়িটার সামনের দিকের দেয়াল প্রায় পুরোটাই কাঁচের। ভেতরে অফিস। ডেস্ক, চেয়ার, ফাইলিং কেবিনেট দেখেই বোঝা যায়। গুদাম থেকে বড় বড় চ্যাপ্টা বাক্স এনে তোলা হচ্ছে বায়ের চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাকে। ওটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ট্রাক, মাল বোঝাই। সেটা থেকে মাল খালাস করে নিয়ে গিয়ে ভরা হচ্ছে গুদামে। দু-তিনজন লোক অফিস থেকে কিছুক্ষণ পর পরই বেরিয়ে। এসে গুদামে ঢুকছে, বাদামী কাগজে মোড়া চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা প্যাকেট বয়ে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছে অফিসে। বুঝতে অসুবিধে হয় না প্যাকেটগুলোতে রয়েছে কাঁচ। গাড়ি নিয়ে যারা আসছে তাদের অনেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছে ওই কাঁচ।
কাউকেই কিন্তু সাইকেলওয়ালার মতো লাগছে না, কর্মচারীদের কথা বললো কচি।
না, একমত হলো কিশোর। ওই লোকটা নিশ্চয় অফিসে কাজ করে। কোনো কেবিনে বসে রয়েছে, কিংবা গুদামের ভেতর। গুদাম-কর্মচারীও হতে পারে। আর সেলসম্যান হলে তো অফিসে থাকবে না। নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে দোকানে দোকানে খোঁজ নিতে, কার কি মাল লাগবে।
মাল নামানো হয়ে গেলে বেরিয়ে গেল ট্রাক। যেটাতে বোঝাই হচ্ছিলো, সেটা রইলো, মাল তোলা এখনও শেষ হয়নি।
কি করবো, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবোই?
না, খালি হওয়ার অপেক্ষা করছি, জবাব দিলো কিশোর। ট্রাকগুলো চলে গেলেই গুদামের সামনেটা খালি হয়ে যাবে। মাল খালাস কিংবা বোঝাইয়ের কাজ না থাকলে গুদামের ভেতরেও লোক থাকবে বলে মনে হয় না। তখন কচিকে নিয়ে আমি যাবো অফিসের দিকে। কথা বলার চেষ্টা করবো কর্মচারীদের সঙ্গে। শশী। রুমের জিনিস দেখার ভান করবো। এই সুযোগে তুমি আর মুসা গিয়ে গুদামে ঢুকবে। সূত্র খুঁজবে।
কি সূত্র? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
সাইকেলওয়ালাকে ধরা যায় এরকম কিছু?
আর তোমরা কি জিজ্ঞেস করবে?
আমি না, জিজ্ঞেস করাবো কচিকে দিয়ে। ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। তাছাড়া ওদের গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে চার চারবার। কাঁচের কথাই জিজ্ঞেস করবে। ও দামদর জানবে।
ঠিক আছে, বললো রবিন।
আরও আধ ঘণ্টা কাজ চললো গুদামের সামনের চত্বরে। তারপর বেরিয়ে গেল ট্রাক। চর খালি হয়ে গেল।
সময় হয়েছে, কিশোর বললো অবশেষে। মুসা, রবিন, মনে রাখবে খুব বাজে একটা লোককে নিয়ে কারবার করছি আমরা। বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে যে কোন সময়। সাইকেলওয়ালা এখানে আছে এরকম কোন চিহ্ন দেখলে গুদামের সামনের দরজা কিংবা জানালায় চকের দাগ দিয়ে রাখবে। আশ্চর্যবোধক চিহ্ন। আমি আর কচি সঙ্গে সঙ্গে তখন বাড়ি চলে যাবো। মামাকে বলে পুলিশ নিয়ে ফিরে আসবো।
ছাতের ওপর থেকে নেমে এলো ওরা। অর্ধেক হয়ে বন্ধ হয়ে আছে মার্কেট তৈরির কাজ। বোধহয় টাকা-পয়সার অভাবেই। লোকজন কেউ নেই। ছাতে। উঠতে তেমন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। নামতেও জবাবদিহি করতে হলো না।
গ্লাস কোম্পানির পাশের দরজাটাও খোলা, সামনেরটাও। এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে ঢুকে পড়লো মুসা আর রবিন। গুদামের দিকে এগোলো।
কচিকে নিয়ে কিশোর ঢুকলো শো রুমে। চারজন খরিদ্দার দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলছে তিনজন সেলসম্যান। কাউন্টারের ওপাশে বিরাট ব্রিট তাক নানা রকম কাঁচে বোঝাই। কিছু কাঁচ আছে নকশা করা, কিছু নকশা ছাড়া। সাদা কাঁচ আছে, রঙিন কাঁচ আছে। এসবই বাড়ি-ঘরের জানালার শার্সিতে লাগানো হয়। খরিদ্দাররা দেখে, পছন্দ করে, অর্ডার দেয়।
বাঁয়ের কাঁচের দেয়ালের ওপাশে আরেকটা ঘর। অফিস। একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ কর্মচারীকে দেখা যাচ্ছে।
খরিদ্দারদের পেছনে দাঁড়িয়ে সেলসম্যানদের দেখছে কিশোর। তাদের একজন। মোটাসোটা বয়স্ক মানুষ। আরেকজন লম্বা, পাতলা, তরুণ। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল কচি আর কিশোরের। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকালো। ওরা।
কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এখন কথা বলছে দুজন খরিদ্দার।
এই সুযোগে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলো কিশোর। কাঁচের দেয়ালের ওপাশের মহিলা তরুণী। যথেষ্ট লম্বা, প্রায় পুরুষের সমান, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। পুরুষদের একজন লম্বা, মাঝবয়েসী। কোণের দিকে কাঁচে ঘেরা একটা খুপরিমতো ঘরে বসে আছে। একা। খুপরির কাঁচের দেয়ালে লেখা রয়েছে।
শরাফত আহমেদ
ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
তারমানে ওই লোকটাই এই কোম্পানির মালিক। বেশ বড় একটা ডেস্কের ওপাশে বসে আছে লম্বা আরেকজন মানুষ। বয়েস প্রৌঢ়ত্বের কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। ডেস্কে তার পদবী লেখা প্ল্যাস্টিকের বোর্ড দাঁড়িয়ে রয়েছেঃ
জেনারেল ম্যানেজার।
কিশোর! কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলো কচির কণ্ঠ।