পড়ে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেল কচি। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হলো মুখ। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে কিশোরের একটা হাত খপ করে চেপে ধরে বললো, তোমরা! সত্যি তোমরা এসেছ বাংলাদেশে! উফ, কি যে ভালো লাগছে! নাম শুনেই সন্দেহ হয়েছিলো! ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে আমার, এক্কেবারে সময়মতো পেয়ে গেছি তোমাদের! ইস, বিশ্বাসই করতে পারছি না।
ওই যে, রবিন আর মুসা আসছে, দরজার দিকে হাত তুললো কিশোর।
ওদের কাছে আরেক দফা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো কচি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে যাচ্ছিল ওদের সঙ্গে। হেসে জানিয়ে দিলো কিশোর, ওরা দুজনে বাংলা বোঝে। বলতেও পারে মোটামুটি।
আলাপ পরিচয়ের পালা শেষ হলো।
অদ্ভুত কাণ্ড, বুঝলে,কচি বললো। গভীর রহস্য!
বলেই ফেললো না, হেসে বললো কিশোর। কখন থেকেই তো জানতে চাইছি।
কতোখানি শুনেছো?
ঘরে বসে তোমরা বাপ-বেটায় যতোখানি ঝগড়া করেছে।
আমাদের গাড়ির কাঁচ, বুঝলে, পিকআপটার উইশীল্ড, কচি জানালো, কি করে জানি ভেঙে যায়। একবার না দুবার না, চার চারবরি ভাঙলো। কাস্টোমারের বাড়িতে মাল দিতে ঢুকি, বেরিয়ে এসে দেখি ভেঙে রয়েছে।
কি করে ভাঙে কিছুই আন্দাজ করতে পারো না?
নাহ, এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো কচি। শেষবার অবশ্য কাঁচ ভাঙার শব্দ কানে এসেছিলো। ছুটে বেরোলাম। কিন্তু গাড়ির কাছে কাউকে দেখতে পেলাম না। এক এক করে তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকালো সে। খুব অবাক। লেগেছে আমার। মনে হলো যেন আপনাআপনি ভেঙে গেল কাঁচটা।
হয় এরকম, আনমনে বললো কিশোর। একে বলে কাঁচের ফ্যাটিগ। আপনাআপনি চুরমার হয়ে যায় কাঁচ। তবে সেটা একআধবার হতে পারে। একই গাড়ির বেলায় চারবার? উঁহু, সেটা সত্ব না।
আমিও তাই বলি, চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়লে কচি। আপনাআপনি ভাঙেনি ওই কাঁচ।
মনে হয় রহস্য একটা পেয়েই গেলাম, বিড়বিড় করলো গোয়েন্দাপ্রধান।
রবিন আর মুসা চুপ করে শুনছে। কিছু বলছে না।
গোড়া থেকে সব খুলে বলো তো, কিশোর বললো। কখন, কোথায় ঘটেছে এই ঘটনা?
নাক চুলকালো কচি। তারপর শুরু করলো, গুলশানের সাত নম্বর রোডের একটা বাড়ির সামনে। রাতের বেলা। পথের পাশে সব সময় যেখানে গাড়ি রাখে। আব্বা, সেখানেই রেখেছিলাম। ডিম আর দুধ সাধারণত রাতে দিয়ে আসি আমরা, মাখন সকাল বেলা। অনেককে দুধও সকালেই দিই। যা-ই হোক, গত দুমাসে রাতের বেলা, সাত নম্বর রোডে কাঁচ ভেঙেছে মোট চারবার।
অন্য একটা প্রশ্ন করি। তুমি আর তোমার আব্বাই কি মাল সাপ্লাই দাও? কোন কর্মচারী-টর্মচারী নেই?
কারখানায় আছে। আমাদের ফার্মটা খুব ছোট। বেশি লোক রাখতে পারি না। ভীষণ খাটতে হয় আব্বাকে। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর আমার ছোট ভাই যতোটা পারি সাহায্য করি।
হু, বলে চুপ করে কি ভাবতে লাগল কিশোর।
মুসার দিকে তাকালো কচি। আচ্ছা, তোমার না একটা কুকুর আছে, সিমবা? শুনলাম, ওকেও নিয়ে আসবে। কই?
আনিনি। হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালে।
ওটাকে এখানে এনেও কোন লাভ হতো না, কিশোর বললো। বুনো কুকুরের রক্ত শরীরে, কিছুতেই হিংস্রতা ভুলতে পারে না। কখন কার ওপর লাফিয়ে পড়ে টুটি ছিঁড়ে দেবে শহরের রাস্তায় ওটাকে নিয়ে বেরোনোই মুশকিল। ওর জায়গা আফ্রিকা, কিংবা অন্য কোন জঙ্গল-টল…
তারমানে জঙ্গল ছাড়া ওকে সঙ্গে রাখে না? হেসে জিজ্ঞেস করলো কচি।
না রাখাই উচিত। মুসাদের বাসার কাছেই বের করেছিলো একদিন। দিলো এক ছোকরাকে কামড়ে। অনেক কষ্টে পুলিশের ঝামেলা এড়ানো গেছে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার আগের কথা তুললো কিশোর, শেষ বার কবে ভাঙলো তোমাদের গাড়ির কাঁচ?
গত বুদ্বার রাতে। আর কপালটা কি দেখো, চার দিন ভাঙলো, চার দিনই আমি বেরিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। ফলে আব্বাকেও কিছু বোঝাতে পারছি না।
চিন্তিত ভঙ্গিতে কচির দিকে তাকালো কিশোর। ওভাবে আর কোন গাড়ির উইণ্ডশীল্ড ভেঙেছে, জানো?
কি জানি!
কিছু ভাবছে কিশোর, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো রবিন, কেন?
যদি খালি কচিদেরটাই ভাঙে, জবাব দিলো কিশোর, তাহলে বুঝবো ফ্রেমে দোষ আছে, কিংবা শত্রুতা করে কেউ ভাঙছে। কিন্তু আরও গাড়ির যদি ভেঙে থাকে, তাহলে নিশ্চয় অন্য কারণ।
তা ঠিক, ঘাড় দোলালো মুসা।
এই দাঁড়াও, দাঁড়াও! হাত তুললো কচি। মনে পড়েছে! গুলশানে আমার এক বন্ধু আছে। আমাদেরটা ভাঙার কিছুদিন আগে ওদের গাড়ির কাঁচ ভাঙার কথা কি যেন বলেছিলো। তখন খেয়াল করিনি। এখন মনে পড়ছে। কি করে ভেঙেছিলো, বুঝতে পারছিলো না সে-ও।
হু, মাথা দোলালো কিশোর, তাহলে তো মনে হচ্ছে…
থেমে গেল সে। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তার মামী। মহিলার বয়েস বোঝা যায় না। অনেক কম মনে হয়। খুব সুন্দরী। এক ছেলে আর এক মেয়ে, দুজনেই থাকে আমেরিকায়।
হাত নেড়ে হেসে বললেন তিনি, এই, আর কতো গল্প করবি? সেই কোন। সকালে নাস্তা করেছিস। খিদে পায়নি?
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা। একান ওকান হয়ে গেল হাসি। পায়নি মানে, কি যে বলো তুমি, আন্টি। পেটের মধ্যে কখন থেকেই তো ছুঁচো নাচছে, শুধু ভাঙা কাঁচই এতোক্ষণ আটকে রেখেছিলো। নানারকম বাংলাদেশী খাবার খাইয়ে দুদিনেই মুসাকে একেবারে ভক্ত বানিয়ে ছেড়েছেন মামী। ইতিমধ্যেই বহুবার বলে ফেলেছে তাঁকে মুসা, দুনিয়ায় শুধু দুজন মানুষ ঠিকমতো রাঁধতে জানে। একজন তুমি, আরেকজন আমাদের মেরিচাচী।