মিটিমিটি হাসছে করিম।
শেয়ালের জারি গান একবিন্দু পছন্দ করতে পারেনি গায়ের কুকুরের দল। পাগল হয়ে গেল যেন ওগুলো। চারদিক থেকে ভেসে আসছে এখন ওগুলোর হাঁকডাক।
পাত্তাই দিলো না শেয়ালের দল। আরও কয়েকবার ডেকে খেলা জুড়ে দিলো। তবে সবাই নয়, ছোটগুলো। বড়রা স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ওদের খেলা। সেই সঙ্গে চললো গুরু-গম্ভীর আলোচনা।
থেকে থেকে জারি গান শুরু করে শেয়ালেরা। শোনামাত্র খেপে উঠে। কুকুরগুলো। যেন ওগুলোকে খেপানোর জন্যেই এমন করে ওরা।
সভা ভাঙলো এক সময়।
আবার দীঘির পাড়ের গর্তের দিকে ফিরে চললো শেয়ালের দল।
খাইছে! বিড়বিড় করে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো বিস্মিত মুসা।
আশ্চর্য! জোরে বললো না রবিন, যেন আমেজ কেটে যাওয়ার ভয়ে। কয়োট আর নেকড়ে এ রকম সভা করে শুনেছি। শেয়ালেরাও যে করে জানতাম না।
না করার কোনো কারণ নেই, কিশোর বললো। হাজার হলেও জাতভাই। শেয়ালের এ রকম জলসা বসানোর কথা চাচার কাছেও শুনেছি। চাঁদনী রাতে নাকি সুন্দর বনের হরিণেরাও জলসা বসায়, নাচে। বনের মধ্যে মধু জোগাড় করতে যায় যে সব মৌয়াল, তারা এসে এসব কিচ্ছা বলে।
বানিয়ে বলে? মুসার প্রশ্ন।
আগে সে রকমই মনে হয়েছে। কিন্তু এখন আর বলব না সে কথা। চোখের সামনেই যে কাণ্ডটা ঘটতে দেখলাম!
বড় করে হাই তুললো করিম। বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকালো মুসার দিকে। রাইত অনেক অইছে। লও, বাড়িত যাই।
.
১০.
আরেক সোমবার এলো অবশেষে। মাঝখানে কয়েকটা দিন। তবে মোটেও। একঘেয়ে লাগেনি তিন গোয়েন্দার। ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেছে যেন। অনেক দেখেছে ওরা, অনেক ঘুরেছে। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। হই হট্টগোল আর আনন্দ করেছে। ইতিমধ্যে একদিন মামার সঙ্গে গিয়ে পাখি শিকার করে এসেছে। তবে সব কিছুর মাঝেও বারে বারে ঘুরে ফিরে মনে এসেছে। প্রশ্নগুলোকে কাঁচ ভাঙে? কি করে ভাঙে? কেন ভাঙে? ঈগলের সঙ্গে গাড়ির কাঁচ ভাঙার কি সম্পর্ক? কে চুরি করলো মুদ্রাটা?
সোমবার দুপুর বেলায়ই আরিফ সাহেবের বাড়িতে চলে এলো কচি। কিশোর বললো তাকে, আজই আরেকবার ভূত-থেকে-ভূতে চালান দিতে চাই।
আবার?
হ্যাঁ। কেন, ভুলে গেলে, আরেকবার চালান দেয়ার কথা ছিলো না? ভিনগ্রহের মানুষের খোঁজ চেয়ে?
এবার রবিন আর মুসাও অবাক। সমস্বরে বলে উঠলো, ভিনগ্রহের মানুষ!
তোমরাই তো বললে। টেন-স্পীড যে চালায় তাকে ভিনগ্রহের মানুষের মতো লাগে।
অনেক জায়গায় ফোন করলো কচি, তার বন্ধুদের। বলে দিলো কি করতে হবে। হুঁশিয়ার করে দিলো, যাতে লুকিয়ে থেকে নজর রাখে। সাইকেলওয়ালা যেন টের না পায়। জানিয়ে দিলো, কেউ খবর পেলে যেন ওদের বাড়িতে টেলিফোনে। রচিকে জানায়। বাড়িতে ফোন করে তার ছোট ভাই রচিকে বুঝিয়ে বললো, ভূতদের ফোন যদি আসে, যা যা বলে নোটবুকে লিখে রাখতে। আরিফ সাহেবের ফোন নম্বর দিয়ে বললো নয়টা পর্যন্ত ওই বাড়িতেই থাকবে। ইতিমধ্যে যদি ফোন। আসে, সঙ্গে সঙ্গে সে যেন জানায়।
সকাল সকাল রাতের খাবার খেয়ে নিলো সেদিন ওরা। তারপর বসার ঘরে এসে বসলো। ফোন আসার অপেক্ষা করছে। আটটা বাজলো। এলো না। গেল আরও পনেরো মিনিট সাড়ে আটটায় বেজে উঠলো ফোন। ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিলো কচি। তার ভাইই ফোন করেছে। উত্তেজিত হয়ে বললো, সর্বনাশ। হয়েছে! একগাদা গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে!
দাঁড়া দাঁড়া, কাগজ-কলম বের করি! কচি বললো। আস্তে আস্তে বল!
নোটবুকে লিখে রাখা তথ্য পড়লো ওপাশ থেকে রচি, ক্যাপ, চশমা, হেডফোন আর ব্যাকপ্যাক পরা একটা লোক সাইকেল চালিয়ে গেছে ধানমণ্ডির দশ নম্বর রাস্তা দিয়ে। এইমাত্র একটা গাড়ির কাঁচ ভাঙলো। সাইকেল চালককে কিছু করতে দেখা যায়নি।
মুখ বাঁকালো মুসা। তারমানে ও কিছু করেনি।
তাই তো মনে হয়, ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। কিন্তু সে ছিলো ওখানে।
আট নম্বর রাস্তায় দেখা গেছে সাইকেল আরোহীকে, রচি বললো। কালো একটা টয়োটা প্রিন্টারের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। লোকটা গাড়ির কাছে থামেনি।
থামেনি! কচির মুখে শুনে প্রায় চিৎকার করে উঠলো মুসা।
কিন্তু ও যাওয়ার সময়ই তো ভেঙেছে কাঁচ! রবিন বললো। সে না হলে আর কে?
ছয় নম্বর রাস্তায় আর একটা টয়োটার কাঁচ ভেঙেছে। সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে, ভাইয়ের কাছে শুনে বললো কচি। শার্টের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করছিলো।
কী? আবার চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
দাঁড়াও দাঁড়াও, শুনি, হাত তুললো কচি। হ্যাঁ, রচি, বল।
জানা গেল, বারো নম্বর রাস্তায় গগলস পরা টেন-স্পীড সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে। ওই রাস্তায় কোনো গাড়ির কাঁচ ভাঙেনি। চোদ্দ নম্বর রাস্তায়ও সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে। একটা টয়োটা পাবলিকার কাঁচ ভাঙা হয়েছে। শার্টের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করেছিলো সে।
কিন্তু কি রে করছিলো? প্রশ্ন করলো রবিন। গাড়ির কাঁচ ভাঙা যায় এমন কিছু?
ভাঙতে হলে হয় ভারি কিছু দিয়ে পিটাতে হবে, নয়তো ছুঁড়ে মারতে হবে, যুক্তি দেখালো মুসা। আর সে রকম কিছু করে থাকলে চোখে পড়তে বাধ্য। পড়লো না কেন?
রচি জানালো, ষোল নম্বর রাস্তায় দেখা গেছে সাইকেল আরোহীকে। একটা টয়োটা স্টারটেলের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। মনে হলো গাড়ির দিকে কোনো কিছু নিশানা করছিল লোকটা। কিন্তু এতো দ্রুত সরে চলে গেল, যে ছেলেটা চোখ রেখেছিলো সে ঠিকমতো দেখতেই পারেনি। রাস্তার কয়েকটা পোস্টে আলোও ছিল না।