উঠানে নেমে নাড়ার আগুন জ্বাললো করিম। অগ্নিকুণ্ডের পাশে পিড়ি পেতে দিয়ে তিন গোয়েন্দাকে ডাকলো ওখানে গিয়ে বসতে।
গোল হয়ে বসলো সবাই।
বাঁশের ছোট টুকরিতে করে খেত থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে অনেক মটরশুটি। আগুনে সেগুলো পোড়াতে দিয়ে করিম বলল, বিকালে তুইল্লা আইন্না রাখছে আমার ভাই। পোড়াইয়া খাইতে খুব মজা লাগে।
মাথার ওপরে খোলা আকাশ। নিচে অন্ধকার নীরবতার মাঝে আগুনের পাশে গল্প চললো ওদের। কথায় কথায় করিম জানালো, চাঁদ উঠলে নাকি মুন্সী বাড়ির দীঘির পাড়ে শেয়ালের আসর বসে। শেয়ালদের রাজা থাকে, মন্ত্রী থাকে, বিচার আচার চলে অনেক রাত পর্যন্ত। জলসা হয়।
বিশ্বাস করলো না মুসা। মুচকি হাসলো।
রেগে গেল করিম। জেদ ধরে বললো, বিশ্বাস করলা না? দ্যাখতে চাও?
মাথা ঝাঁকালো মুসা।
ঠিক আছে। চান উঠুক। তারপর যামু।
অনেক রাতে বাঁশ বনের মাথা ছাড়িয়ে উঠে এলো হলদে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো করিম। পুরানো চাদরটা ভালোমতো গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো, চল, সময় অইছে।
বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে গেছে পায়ে চলা পথ। সঙ্গে টর্চ এনেছে তিন গোয়েন্দা। করিমের সঙ্গে চলতে অসুবিধে হলো না। এ যেন এক রহস্যময় জগতে এসে পড়েছে ওরা। বাঁশ গাছের নিচে ঘন অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। জ্যোৎস্না ঢুকতে পারে না।
এমন কি টর্চের আলোয়ও কাটতে চায় না সে অন্ধকার। সামান্য বাতাস। লাগলেই সড়সড় করে বাঁশের পাতা, গাছের ফাঁক দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে যায়। বাতাস, যেন অশরীরী কোনো প্রেতাত্মার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। ধক করে ওঠে বুকের ভেতরটা। ছমছম করতে থাকে গা।
বাঁশবন থেকে বেরোতেই দেখা গেল ধবধবে সাদা মাঠ। ফসল কাটা শেষ। একটা ঘাস নেই কোথাও। সমস্ত খেত জুড়ে পড়ে রয়েছে মাটির ঢেলা। ঘোলাটে চাঁদের আলোয় দূর থেকে দেখলে মনে হয় দিগন্তজোড়া বিশাল এক সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে যেন কেউ। খেতের ওপর দিয়েই কোণাকুণি চলে গেছে পায়েচলা। পথ। সেই পথে নামলো ওরা। কয়েক পা এগোতে এগোতেই জুতোর ওপর মিহি ধুলোর আস্তরণ পড়লো।
বেশ কয়েকটা খেতের পর মুন্সী বাত্রি সীমানা। অনেক বড় এলাকা নিয়ে বাড়ি। বিরাট দীঘির পাড়ে ঘন বাঁশবন। উঁচু হয়ে আছে দীঘির পাড়। কাছে আসতে দেখা গেল কালো কালো অনেক গর্ত।
এই গুলান শিয়ালের গর্ত, জানালো করিম। আমরা বসমু গিয়া দীঘির ঘাটলায়। চুপচাপ।
শান বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ির ওপরে বেশ চওড়া একটা প্ল্যাটফর্ম মতে, তাতে বেশ সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইট-সিমেন্টের চেয়ার। পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা। সিঁড়ি যতদিন থাকবে এগুলোও থাকবে, নষ্ট হবে না।
সেই চেয়ারে এসে বসলো ওরা।
এইবার খালি বইয়া থাকো চুপ কইরা, করিম বললো।
কখন আসবে? মুসা জিজ্ঞেস করলা।
আইবো, সময় অইলেই।
সময় যায়। চুপ করে বসে আছে ওরা। ফিসফাস পর্যন্ত করছে না। কানের কাছে মশা পিনপিন করছে। চাপড় মারতে গিয়েও মারছে না। যদি আওয়াজ শুনে শেয়ালেরা আসা বন্ধ করে দেয়।
রাত বাড়ছে। মাথার ওপরে উঠে এসেছে চাঁদ। মস্ত বড়। ঘোলাটে ভাব দূর হয়ে গেছে অনেকখানি, হলদেটে রঙ কেটে গিয়ে সাদা হয়ে উঠেছে। পুকুরের পানির ওপর ধোয়ার মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ছে কুয়াশা।
দূর, আসবে না, আর ধৈর্য রাখতে পারছে না মুসা।
আইবো, আইবো। দ্যাখো না খালি।
রবিন চুপ হয়ে আছে। কিশোরও। করিমের কথা বিশ্বাস করেছে। এতো জোর দিয়ে যখন বলছে, নিশ্চয় আসবে।
আরও কয়েক মিনিট কাটলো। হঠাৎ মুসার বাহু খামচে ধরলো করিম। হাত তুলে দেখালো ঢেলা-খেতের দিকে।
প্রথমে কিছু চোখে পড়লো না। তারপর তিনজনেই দেখলো, দীঘির পাড়ের দিক থেকে খেতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে একটা জানোয়ার। কুকুরের মতো দেখতে। বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলেদুলে ধীরেসুস্থে চলেছে। গিয়ে বসলো ওটা খেতের একটা আলের ওপর।
পাড়ের কাছ থেকে আরেকটা শেয়াল বেরোলো। বসলো গিয়ে প্রথমটার সামনে, মুখোমুখি, যেন আলাপ করতে বসেছে। তারপর যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হতে লাগলো একের পর এক শেয়াল। কোনোটা একা, কোনোটা জোড়া বেঁধে, আবার কেউ কেউ বাচ্চা-কাচ্চা, পরিবার-পরিজন নিয়ে। দল বেঁধে এগোলো সবাই প্রথম। শেয়াল দুটোর দিকে।
আলে বসা প্রথম শেয়ালটার সামনে গোল হয়ে বসলো ওগুলো। যেন বিচারে বসেছে গাঁয়ের মোড়ল। তার সামনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী।
দীঘির পাড়ের গর্তে বোধহয় আর একটা শেয়ালও রইলো না। সব গিয়ে। সামিল হয়েছে সভায়। চাঁদের দিকে মুখ তুলে লম্বা হাঁক ছাড়ল প্রথম শেয়ালটা। ওটাই নেতা, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওটার ডাক মিলাতে না মিলাতেই হা-উ উ-উ-উ-উ করে ডেকে উঠলো আরেকটা। সুর মেলালো আরেকটা। তারপর আরও একটা। সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো সবগুলো। মহা আনন্দে কেউ কেউ করে লাফালাফি শুরু করলো বাচ্চাগুলো।
সে এক বিচিত্র জারি গান। কেউ বলছে হাউ, কেউ বলছে হোউ, কেউ কা-হুঁয়া, কেউ বা আবার হুক্কা-হুঁয়া। দু-একটা আবার তার জের টানছে হুয়া হুয়া হুয়া হুয়া। বলে। থ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। বাস্তবে এ রকম কিছু ঘটতে পারে, তা-ও আবার নিজের চোখে দেখবে, কোনো দিন কল্পনাই করেনি ওরা।
আড়চোখে করিমের দিকে তাকালো মুসা।