আমি রেখেছি ওগুলো, হেসে বললো কচি। মাঝে মাঝে কাজে লাগে।
এটা কি? জুতোর তলায় চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া মটর দানার চেয়ে ছোট একটুকরো ধাতব জিনিস বের করে দেখালো মুসা।
হাতে নিয়ে দেখলো রবিন। চিনতে পারলো না।
কচিও পারলো না।
যাই হোক, মুসা বললো। বেশি ছোট। এটা দিয়ে ঢিল মেরে কাঁচের কিচ্ছ। করা যাবে না। তবে জিনিসটা চেনা চেনা লাগছে।
লাগবেই, বললো রবিন। সীসা। কোনো জিনিস ঝালাই-টালাই করতে গিয়ে পড়ে থাকতে পারে।
হাতের তালুতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো কিশোর। চিনলো না। ফিরিয়ে দিলো আবার মুসাকে। নিজের অজান্তেই জিনিসটা পকেটে ভরলো মুসা। আবার খোঁজাখুজি চললো। কাঁচ ভাঙা যেতে পারে, ওরকম কিছুই পাওয়া গেল না।
কচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে চললো তিন গোয়েন্দা।
বাগানে ছিলেন মামী। ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলেন বাগানের কিনারে। এসেছিস। যা, হাতমুখ ধুয়ে নে গে। চা দিচ্ছি।…ও, হ্যাঁ, কিশোর, সানি নামে একজন ফোন করেছিলো। আসতে না আসতেই কতোজনের সঙ্গে পরিচয় করে ফেললি। ফোনও করে।
হাসলো কিশোর। কিছু বললো?
বললো তার চাচা নাকি মত পরিবর্তন করেছেন। যা ঘটে গেছে তার জন্যে অনুতপ্ত।
আবার যাবো! মুসা বললো। কিশোর, এবার পয়সা দিতে রাজি না হলে আর যাচ্ছি না আমি। যেমন লোক, তেমনি তার ব্যবস্থা। বিনে পয়সায় কাজটা করে। দিতে চেয়েছিলাম, ভাল্লাগেনি।
হ্যাঁ, ঠিক, তুড়ি বাজালো রবিন। অন্তত মোটা একটা পুরস্কার ঘোষণা না। করা পর্যন্ত ওঁর মোহর আর খুঁজতে যাচ্ছি না।
কিন্তু ওদের কথায় তেমন কান নেই কিশোরের। জিজ্ঞেস করলো, মামী, আজ বাইরে কাউকে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখেছো?
অদ্ভুত আচরণ? অবাক হলেন মামী। না তো!
বেশ, অদ্ভুত আচরণ না হয় না-ই করলো, থামের মাথায় উঠেছিল কেউ? যে ধাতব থামটা থেকে টেলিফোনের তার এসে ঢুকেছে এই বাড়িতে সেটার দিকে হাত তুললো কিশোর।
না, মাথা নাড়লেন মামী। দাঁড়া দাঁড়া, দেখেছি। মেকানিক। ফোনের তার। চেক করতে আসে যে, ওদেরই একজন। লোকটা নতুন। চিনি না।
কখন সেটা? আগ্রহ দেখাল কিশোর।
এই তো, তোরা বেরোনোর একটু আগে। বাগানেই ছিলাম আমি তখন, দেখলি না? যা, হাত-মুখ ধো গিয়ে।
কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না মুসা। ওরা ওখান থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপারটা কি, কিশোর?
লোকটা কি ছদ্মবেশী? রবিনের প্রশ্ন। আসল মেকানিক নয়? এ বাড়ির ওপর চোখ রাখছিলো?
রাখতেও পারে, দায়সারা জবাব দিলো কিশোর। এ নিয়ে পরে চিন্তা-ভাবনা করবো। সোমবারের আগে অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপাতত হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে চলো চা খাইগে।
.
০৯.
পরদিন করিমদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেল তিন গোয়েন্দা। দাওয়াত রাতে, অথচ নেয়ার জন্যে দুপুরবেলাই এসে বসে রইলো ছেলেটা।
করিমের মায়ের আদর-যত্নে অভিভূত হয়ে গেল ওরা। সম্পন্ন গৃহস্থ করিমের বাবা, বাড়ি-ঘরের অবস্থা দেখেই সেটা আন্দাজ করা গেল।
বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই শুরু হলো খাবার আসা। খানিক পর পরই এটা নিয়ে আসেন করিমের মা, ওটা নিয়ে আসেন। নানা রকম পিঠা, খেজুরের রসে। তৈরি পায়েস, চিড়া-মুড়ির মোয়া। থালায় করে নিয়ে আসেন, আর বলেন, খাও, বাবারা, খাও। আমরা গরীব মানুষ। ভালা জিনিস ত আর খাওয়াইতে পারুম না। এগুলানই খাও।
বৈঠকখানায় ভিড়। প্রায় সবাই করিমের সমবয়েসী গায়ের ছেলে। বিদেশী বন্ধুদের দাওয়াত করে আনছে একথাটা প্রায় ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো। সে। ওদের আঞ্চলিক সব কথা বুঝতে পারে না মুসা, তা-ও ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে।
শীতের রাত। আটটা বাজতে না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে গাঁয়ের লোক, নিঝুম। হয়ে যায় পাড়া। কচিত কারও ঘরে কুপির কাঁপা আলো চোখে পড়ে। তিন গোয়েন্দাকে দেখতে আসা ছেলেরা চলে গেল আটটা বাজার আগেই। সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিছু কিছু জিনিস ওদেরকে উপহার দিয়েছে গোয়েন্দারা। খুব খুশি হয়েছে ছেলেগুলো। ঢাকায় তিন গোয়েন্দা–
রসুই ঘরে ভাত বেড়ে দিয়ে খেতে ডাকলেন করিমের মা।
হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো। মাটির মেঝেতে মাদুরের ওপর খেতে বসলো। তিন গোয়েন্দা। এ রকম ভাবে খায়নি আর কখনও। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওদের। আবছা অন্ধকার, খাবারও ঠিকমতো দেখা যায় না। ঘরের ভেতরে কেমন এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ। ওরা জানে না, শুকনো পাট, কাঁচা সরষে, আর অনেক পুরানো তেল চিটচিটে কাঁথা-বালিশের মিশ্র গন্ধ ওটা।
কড়া ঝাল দেয়া মুরগীর মাংস, লাল চালের ভাত, মসুরের ডাল, আর নানা রকম সজী। সেই সাথে প্রচুর কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ।
সাধারণ খাবার। কিন্তু খেতে খেতে মুসার মনে হলো খাবারের এই স্বাদ আগে কমই পেয়েছে। পরিবেশের জন্যেই বোধ হয় ভালো লাগছে এতোটা। মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আন্তরিকতাও যোগ হয়েছে এর সঙ্গে। রুটি খেতে অভ্যস্ত যে রবিন, তারও খারাপ লাগছে না খেতে। শুধু ঝালটা একটু বেশি লাগছে। খানিক পর পরই পানি গিলতে হচ্ছে। নাক-চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে ঝালের চোটে।
খাওয়া সেরে বাইরে দাওয়ায় এসে বসলো ছেলেরা। রাতে থাকবে। কাজেই কম্বল-টম্বল নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে।
পরিষ্কার আকাশ। তবু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। কুয়াশার জন্যে। অনেক গাছপালা এখানে। বাড়ির সামনে একটা পুকুর। তিন পাড়ে বাঁশঝাড়। ঘন কালো। দেখাচ্ছে এখন। পুকুরে শব্দ করে ঘাই মারছে কাতলা মাছ। বাঁশ বনে কর্কশ গলায় ডেকে উঠলো একটা পেঁচা। তার পর পরই শোনা গেল ঝাড়ের ওপাশের খেত। থেকে আসা শেয়ালের হুক্কা-হুয়া।