গাছপালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে খোয়া বিছানো পথ। গাছের কারণে। সামনের দরজাটা প্রায় চোখেই পড়ে না।
কাছে এসে কলিং বেলের সুইচ টিপলো কিশোর। দরজা খুললো না।
এখুনি আসতে বলেছিলো? দরজা খুলছে না দেখে সন্দেহ হলো মূসার। ঠিক শুনেছো?
হা, জবাব দিলো কিশোর।
হঠাৎ বাড়ির অনেক ভেতর থেকে শোনা গেল রেগে যাওয়া কণ্ঠস্বর। দ্রুত। আরও কয়েকবার সুইচ টিপলো কিশোর। দরজা এবারও খুললো না, তবে কথা থেমে গেল।
বেলটাই বোধহয় কাজ করে না, রবিন বললো।
পাশে ঢোকার অন্য দরজা থাকতে পারে, মুসার অনুমান।
আবার রাস্তায় ফিরে এসে আশেপাশে উঁকি দিতে লাগলো ওরা। গ্যারেজটা যে পাশে সে পাশে আর কোনো দরজা দেখা গেল না।
ওটা কি? অদ্ভুত একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। পাশের খোলা চত্বরে চিত হয়ে আছে চার ফুট চওড়া একটা ধাতব জিনিস। দেখতে পিরিচের মতো। নিচে তিনটে পা। আকাশের দিকে পেট।
স্যাটেলাইট ডিশ, কিশোর বললো।
মহাকাশের স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো সঙ্কেত ধরে, জানালো রবিন। টেলিভিশন আর রেডিওর সঙ্কেত গিয়ে স্যাটেলাইটে ধাক্কা খেয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। আর আসে বলেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক দূর থেকে পাঠানো টেলিভিশনের ছবি দেখি, রেডিও শুনতে পাই আমার। এখানকার আইন জানিনে, তবে আমেরিকায় এই ডিশের মাধ্যমে সঙ্কেত ধরে টিভি দেখলে কিংবা রেডিও শুনলে কেবল কোম্পানিকে পয়সা দিতে হয় না। খরচ বাঁচে।
কিশোর বললো, এখানে ওরকম কোন কোম্পানি নেই। রেডিও, টিভি দুটোই সরকারী। লাইসেন্সের খরচ দিতেই হবে।
তাহলে এটা রেখেছে কেন? মুসার প্রশ্ন।
হয়তো এমনি। কিংবা ওটাকে অ্যান্টেনা হিসেবে কাজে লাগায়। কোনো সময় আমেরিকায় ছিলেন হয়তো ভদ্রলোক, তখন কিনেছিলেন, আসার সময় নিয়ে এসেছেন সাথে করে।
মনে হয়, একমত হলো রবিন।
আবার কথা শোনা গেল। মুসা বলে উঠলো, খান সাহেবের গলা না?
ঘরের ভেতর থেকেই এসেছে বোধহয় কথা, মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না।
এই যে, এসে গেছে, এসো! বাড়ির সামনের দিক থেকে শোনা গেল আরেকটা কণ্ঠ। তাড়াতাড়ি আবার সামনের দরজার কাছে চলে এলো ছেলেরা। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সানি। কেমন যেন দ্বিধান্বিত। এসো, আবার বললো সে।
কয়েকবার বেল বাজালাম, বাড়ির পাশে চলে যাওয়ার কৈফিয়ত দিলো। কিশোর, কেউ খুললো না। ওদিকে আর কোনো দরজা-টরজা আছে কিনা দেখতে গিয়েছিলাম।
সরি, সানি বললো। পেছন দিকে ছিলাম আমরা। চাচার সঙ্গে কথা। বলছিলাম। বেল শুনিনি।
ওদের নিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। বাড়িটা পুরানো, কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। গুলশান-বনানীর আর দশটা আধুনিক বাড়ি থেকে আলাদা, অনেকটা পুরানো ঢাকার বাড়ির মতো। এ
চাচার শরীরটা ভালো নেই আজ, সানি বললো। শুয়ে আছেন। আমাকেই তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। ওই ঈগলটা খুঁজে দেয়ার ব্যাপারে আর
আসলে, রবিন বললো, এই কেসে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে গেছি আমরা। কে কাঁচ ভাঙে রার জন্যে কচিকে সাহায্য করছি।
তাই তো। ভুলেই গিয়েছিলাম।
নতুন একটা আঙ্গিক যখন পাওয়া গেল, কিশোর বললো, এদিক থেকেও তদন্ত চালাতে পারি আমরা। হয়তো ঈগল খুঁজতে গিয়েই কাঁচ যে ভাঙে তাকে ধরে। ফেলতে পারবো। চুরি যখন করেছে; নিয়ে গিয়ে নিশ্চয় বিক্রিরও চেষ্টা করবে।
কি করে? মুসা বললো। এতে দামী জিনিস বেচবে কার কাছে? সাধারণ লোকে কিনবে না। টাকা এবং শখ দুটোই যার আছে সে ছাড়া। আর এখন কেনার ঝুঁকিও নিতে চাইবে না কেউ সহজে। চুরির খবর জেনে ফেলেছে অনেকে। এতে টাকা দিয়ে কিনে পুলিশের ঝামেলায় কেউ পড়তে চাইবে না।
এসব জিনিস যারা সংগ্রহ করে তাদেরকে চেনো না তুমি, মুসা, কিশোর বললো। কিছু লোক আছে, যারা রীতিমতো পাগল হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান। থাকে না। যে-কোনো ঝুঁকি নিয়ে বসে। জোগাড় করে লুকিয়ে রেখে দেয়। শুধু নিজে দেখে, কাউকে দেখতেও দেয় না।
মাথা ঝাঁকালো সানি। ও ঠিকই বলেছে। আর এদের টাকাও থাকে প্রচুর। নইলে একটা মুদ্রার জন্যে এতো টাকা কি করে খরচ করবে বলো।
তবে, মুসার কথার খেই ধরলো কিশোর, এটা আমেরিকা নয়। এখানে ওরকম সংগ্রহকারী দু-চারজনও আছে কিনা সন্দেহ। মুদ্রাটা বিক্রি করতে পারবে বলে মনে হয় না।
খুব কঠিন হবে।
আচ্ছা, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ঢাকায় যারা সাপ্লাই দেয়, তাদের নিশ্চয় চেনেন আপনারা। নাম-ঠিকানা বলুন, ওদের ওপর চোখ রাখবো আমরা।
আমি? অস্বস্তি ফুটলো সানির চোখে। চুলে হাত চালাতে চালাতে মাথা নাড়লো। নাহ্, আমি চিনি না। ওসব চাচার ব্যাপার। খুব কমই নাক গলাই আমি।
তাহলে তাকেই জিজ্ঞেস করা দরকার।
চোখ মিটমিট করলো সানি। চাচাকে?…ঠিক আছে, করতে পারবে। আগে তোমাদেরকে কাজে নিয়োগ করুক… হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো সে। আরিব্বাবা…
তার দিকে একটা মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলো কিশোর। তারপর ঘরে চোখ বোলালো। আপনার চাচার নিশ্চয় আরও মুদ্রা আছে। দেখা যাবে? এখানে তো। একটাও দেখছি না।
এখানে রাখে না। পড়ার ঘরে। আবার ঘড়ি দেখলো সে।
দেখা যাবে?
দেখবে? ঠিক আছে, এসো।
লিভিং রুম, তারপর আরেকটা বড় হলঘর পার করিয়ে ওদেরকে পেছনের একটা দরজার কাছে নিয়ে এলো সানি। চাবির গোছা থেকে একটা বেছে নিয়ে তালা। খুললো। ঘরটা ছোট। লাল রঙের পুরু কার্পেট বিছানো। মেহগনি কাঠের ভারি ভারি আসবাব। শেলফগুলো বইয়ে ঠাসা। একধারে সুন্দর করে সাজানো পায়। লাগানো অনেকগুলো সুদৃশ্য কাঁচের বাক্স। ভেতরে গাঢ় নীল মখমলের বিছানায় যেন ঘুমিয়ে রয়েছে নানারকম মুদ্র।