কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল এলেনা। হাসিটা চেপে রাখল মুসা। নাটকীয় ভাবভঙ্গি করে আবার বাজিমাত করে দিয়েছে কিশোর পাশা।
শান্ত দৃষ্টিতে সারা ঘরে চোখ বোলাল কিশোর। এখনও বন্ধ রয়েছে বাথরুমের দরজা। তালায় দোকান রয়েছে পুরনো ধাচের স্কেলিটন কী। এগিয়ে গিয়ে তালা খুলে দরজাটা খুলল কিশোর। মুসা যেভাবে ফেলে গেছে সেভাবেই রয়েছে বাথরুম। জানালার নিচে টেবিলটা রয়েছে।
চাবিটা দিয়ে হলঘর আর শোবার ঘরের মাঝের দরজার তালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর। লেগে গেল। এ বাড়ির যে কোন তালা এ চাবি দিয়ে খোলা যাবে মনে হচ্ছে। মিস লিসটার, পালানোর আগে মুসাকে বাথরুমে আটকেছিলেন আপনার বাবা। মেহমানদের সঙ্গে এরকম ব্যবহারই করেন নাকি উনি?
তোমার বন্ধু মেহমান নয়, কাটা জবাব দিল এলেনা। এখানে কাজ করতে এসেছে।
বেশ, তাহলে কর্মচারী। তো আপনার বাবা কি কর্মচারীদের এরকম করে বাথরুমে আটকে রাখেন?
জবাবের অপেক্ষায় না থেকে মুসার দিকে তাকাল কিশোর। তোমাকে আটকে ফেলার পর ধুপ করে একটা শব্দ শুনেছ বললে। কিছু একটা পড়েছিল। মানুষ পড়ার শব্দ? মিস্টার লিসটার?
হতে পারে। আর কেউ তো ছিল না।
মিস্টার লিসটারের কাছে যখন বসে ছিলে তখন ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছিল?
না, মাথা নাড়ল মুসা। একেবারেই আগুন ছিল না।
গরম আবহাওয়া, আনমনে বলল কিশোর। কেন আগুন জ্বালতে যাবে। ফায়ারপ্লেসে?
বিছানার দিকে তাকাল সে। হলঘরে দেখে এলাম একটা বালিশ ছিঁড়েছে। বিছানায় এখন বালিশ নেই। যেটা ছিঁড়েছে সেটা আগে থেকেই কি ফাটা ছিল? আর আরেকটা বালিশ কোথায়? বিছানায় তো সাধারণত দুটো বালিশ থাকে। কারণ এটা ডাবল বেড।
ভ্রূকুটি করল মুসা। দুটোই থাকার কথা। তবে খেয়াল করিনি আমি।
অবশ্যই দুটো ছিল, এলেনা বলল। দেখ, এসব শার্লক হোমসগিরি করে ভোলাতে পারবে না আমাকে। যাও, নিচে যাও। মেহমানদের খাবার লাগবে…
তার কথা যেন কানেই ঢুকল না কিশোরের। বিড়বিড় করে বলতে থাকল, আজ এখানে কি ঘটেছে বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি। স্পষ্ট। মুসা বাথরুমে। ঢুকেছিল। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন আপনার বাবা, যাতে সে বেরোতে না পারে। তারপর কিছু পুড়িয়েছেন ফায়ারপ্লেসে।
ঘরে ঢুকল এতক্ষণে হোয়েরটা। এমন কিছু, কিশোরের সুরে সুর মিলিয়ে বলল সে, যেটা অন্য কাউকে দেখতে দিতে চাননি। গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তিনি…
দেখ, কডি, কড়া গলায় ধমক দিল এলেনা। ছেলেগুলোকে আর উসকানি দিয়ো না। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, কি করেছে আমি বলি। মূল্যবান কিছু পোড়ায়নি বাবা। ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরানোর জন্যে কাগজ ব্যবহার করেছে। একটা বালিশ ছিঁড়েছে, আরেকটা লুকিয়েছে। নিজেও গায়েব। এসব করেছে। আমাকে রাগানোর জন্যে। কোন কিছু পছন্দ না হলেই এরকম করে। এর চেয়ে খারাপ কাজ করেছে আগেও। বিশ্বাস কর। আজকের এই পার্টি একটুও পছন্দ ছিল। না তার।
তার মানে আপনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছেন? কিশোরের প্রশ্ন। তা-ই যদি করে থাকেন এখন তিনি কোথায়?
নাক দিয়ে খোঁৎখোঁৎ শব্দ করল এলেনা। খুঁজতে শুরু করল। তার সঙ্গে যোগ দিল হোয়েরটা। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে তিন গোয়েন্দাও যোগ দিতে গেল। বাধা দিতে গিয়েও দিল না এলেনা, বরং বলল, ঠিক আছে, খেজ। বেশি লোকে খুঁজলে তাড়াতাড়ি বের করা যাবে।
বিরাট বর্গাকার শোবার ঘরগুলোয় পুরু হয়ে ধুলো জমে রয়েছে। নোংরা। সাফ। করা হয় না। কয়েকটাতে বিছানা আর ড্রেসার রয়েছে। বাকিগুলোতে ছাত সমান উঁচু শেলফে রয়েছে গাদাগাদা বই আর কাগজপত্র।
বই সংগ্রহের বাতিক ছিল, মন্তব্য করল কিশোর।
এটা একটা রোগ, এলেনা বলল। বিশ্বাস কর। আব্বার জন্যে এটা রোগ।
শুধু বইই সংগ্রহ করেননি ডেভিড লিসটার। অনেক ধরনের ট্রফিও রয়েছে। দূরদূরান্তে জাহাজে করে ঘুরে বেড়ানোর প্রমাণ ওগুলো। তুর্কি টুপি, হুকের নল, একজোড়া চামড়ার চটি দেখিয়ে এলেনা বলল, ওগুলো মিশরের বাজার থেকে আনা হয়েছে। আফ্রিকা থেকে এসেছে হাতির দাঁতে খোদাই করা জিনিস। মারাকে থেকে একটা পিতলের ল্যাম্প। পেনসিলের বাক্স আর পুরনো ম্যাগাজিনের পাশে তাকে অগোছাল হয়ে রয়েছে জাহাজ চালনার যন্ত্রপাতি।
কোন জিনিস ফেলে না আব্বা। পরিষ্কার করতেও দেয় না। তার ভয়, কাউকে ঢুকতে দিলেই জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে পালাবে।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। তার জন্যে খারাপই লাগল তিন গোয়েন্দার। বাবা আর মেয়ের স্বভাবে অনেক অমিল। আর তার জন্যে নিশ্চয় মনোকষ্টে ভুগতে হয় মেয়েকে। মেয়ে চায় সাফসুতরো থাকতে, আর বাবাটা একদম নোংরা। এলেনার নিজের ঘরটা ঝকঝকে, তকতকে পরিষ্কার।
দোতলায় আরও একটা ঘর পরিষ্কার আছে, সেটা কমপিউটার রুম। ধুলো ময়লা সহ্য করতে পারে না ওই যন্ত্র, তাই বাধ্য হয়েই সাফ রাখতে হয়। ঘরটা লিসটারের শোবার ঘরের পাশেই। এয়ারকুলার লাগানো। শাদা দেয়াল। লাল রঙ করা ইস্পাতের ফ্রেমের চেয়ার। আর দুটো কমপিউটার কনসোল রয়েছে ঘরে।
একটা সেট রাখা হয়েছে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে, হোয়েরটা জানাল। বাইরে বেরোতেই চান না মিস্টার লিসটার। যোগাযোগ রাখার জন্যে তাই কমপিউটার ব্যবহার করেন। কর্মচারীদের হুকুম দেন এই যন্ত্রের সাহায্যে। কারও সঙ্গেই কথা বলতে চান না। কমপিউটারে আরেকটা মস্ত সুবিধে রয়েছে। কেউ আদেশ পালন না করলে কিংবা কাজে ভুল করে ফেললে রেকর্ড থেকে যায়, কোন ভাবেই ফাঁকি আর দিতে পারে না।