ঠিক! ভাবল মুসা। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ছোট ঘরটায় চোখ বোলাল। জানালায় দৃষ্টি আটকে গেল।
জানালা! হ্যাঁ, জানালা! পুরনো আমলের বাথরুমটায় একটা জানালা আছে। ওটার বাইরে দেয়ালের কাছেই রয়েছে একটা গাছ। বেশ বড় একটা অ্যালডার। গাছ, বেয়ে নামা যাবে সহজেই।
জানালাটা খুলল মুসা। বইগুলো নামিয়ে রেখে টেবিলটা নিয়ে এল জানালার। কাছে। ওটাতে উঠে মাথা বের করে দিল জানালার বাইরে, তারপর বের করল। কাধ।
নিচে তাকাল। চোখে পড়ল বাড়ির একপাশ। ঠিক নিচেই রয়েছে সিমেন্টে বাঁধন পথ। পড়লে হাত-পা ভাঙার ভয় আছে।
তবে সে ভয় তেমন করল না। গাছটাছ ভালই বাইতে পারে। পড়বে না। আর পড়া চলবেও না, অন্তত এখন। মারা যাচ্ছেন লিসটার। মুসা গিয়ে দ্রুত। সাহায্য আনতে না পারলে মারাই যাবেন।
.
০৩.
যতো দ্রুত সম্ভব নামছে মুসা। কোথায় ধরছে, কোথায় পা রাখছে সেদিকেও খেয়াল নেই। বাড়ির এই পাশটা নির্জন, কাউকে চোখে পড়ছে না। কিন্তু সে মাটিতে নামতে না নামতেই একটা লাল চুল ওয়ালা মেয়ে এসে হাজির হল। বাহ, নামার বেশ ভাল উপায় বের করেছ তো! আমি তো জানতাম লোকে সিঁড়ি দিয়েই নামতে চায়।
আমিও চাই। ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করল না মুসা। মেয়েটার পাশ কাটিয়ে দৌড় দিল বাড়ির অন্য পাশে যেখানে লম্বা জানালাগুলো রয়েছে সেদিকে। একটা জানালা গলে যখন ঢুকছে তখনও বাজনা বাজছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে মেহমানদের ট্রে হাতে ঘুরছে রবিন আর কিশোর, ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে সোজা এলেনার দিকে ছুটল মুসা। সেই ধূসর সিল্ক পরা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে মেয়েটা। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে তার হাত চুল সে। ফিরে তাকিয়ে মুসাকে দেখেই ভুরু কুচকে ফেলল এলেনা। তুমি এখানে কেন? ড্রামের ভারি গমগম শব্দকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল সে। এ বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। এখানে কথা বলা অসম্ভব মনে হচ্ছে তার কাছে। ইশারায় এলেনাকে সরে আসতে বলল রান্নাঘরের দিকে।
ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে, যাওয়ার সময় কডি হোয়েরটাকে দেখতে পেল ওরা। ঘরের একধারে হেনরি বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেটে খাবার। সাজাচ্ছে ক্যাটারার। আঙুল বাকা করে ইশারায় হোয়েরটাকে ডাকল এলেনা। খালি রান্নাঘরের দিকে এগোল। তার পেছনে নির্জন রান্নাঘরে চলে এল লোকটা। মুসা ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল যাতে বাজনার শব্দ কম শোনা যায়।
আপনার বাবা আমাকে বাথরুমে তালা আটকে রেখেছিলেন, মুসা বলল। হাত ধুতে গিয়েছিলাম আমি। দুই এক মিনিট পরেই একটা শব্দ শুনলাম। মনে হল তিনি পড়ে গেছেন। চিৎকার করে অনেক ডাকাডাকি করলাম। শুনলেনই না। জবাব দিলেন না। শেষে জানালা গলে বেরিয়ে গাছ বেয়ে নেমে এসেছি…
শোনার জন্যে আর অপেক্ষা করল না এলেনা। পেছনের সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল। তার পেছনে ছুটল হোয়েরটা।
ডাইনিং রুমে ঢোকার দরজাটা ফাঁক হল। মুখ বের করল কিশোর। তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাচ্ছে রবিন।
কি হয়েছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
বারোটা বেজেছে লিসটারের! কি হয়েছে বলল মুসা। এলেনা দেখতে গেছে বাবাকে।
ছাতের দিকে তাকাল কিশোর। তারপর পেছনের সিঁড়ির দিকে। রওনা হয়ে গেল।
কোথায় যাচ্ছ? বাধা দেয়ার চেষ্টা করল রবিন, এলেনা আমাদের কুত্তার মত দূর দূর করে তাড়াবে। বাপ আর মেয়ের তো একই স্বভাব।
মিস্টার লিসটার সত্যিই অসুস্থ হয়ে থাকলে, কিশোর বলল, আমাদের সাহায্য দরকার হবে তার।
যাও, ভুরু নাচাল মুসা। মাথায় ডাণ্ডা খেতে চাইলে। কিন্তু পরক্ষণেই কিশোরের পেছনে রওনা হল সে-ও। কিছুটা কৌতূহলী হয়েই। কিশোরকে কি বলে এলেনা দেখার জন্যেই। তাছাড়া লিসটারের আসলে কি হয়েছে সেটাও দেখার ইচ্ছে।
দ্বিধা করল রবিন। তারপর সে-ও চলল দুজনের পেছনে।
ওপরের হলঘরে. যেন পালকের তুষারপাত হচ্ছে। একটা বালিশ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। খোলটা পড়ে রয়েছে মেঝেতে, ভেতরের পালকগুলো উড়ছে। তার মাঝ দিয়ে ছুটে গেল এলেনা। শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল একবার, নব মোচড় দিয়ে ঠেলে খুলে ভেতরে তাকাল। চেঁচিয়ে উঠল। হোয়েরটা চেঁচাল না। তাকিয়ে রয়েছে ভেতরে।
ওখানেই কোথাও আছে! চিৎকার করে বলল এলেনা। যাবে কোথায়? যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
ঠেলা দিয়ে পাল্লা পুরোটা খুলে দিল হোয়েরটা। ভেতরটা এখন কিশোরও দেখতে পাচ্ছে। বিছানার চাঁদরে কুঁচকে রয়েছে। খানিক আগে যে ওখানে একজন মানুষ শুয়েছিল বোঝা যায়। ফায়ারপ্লেসে নাচানাচি করছে ছোট ছোট আগুনের শিখা। কাগজ পোড়া কালো ছাই, গরম বাতাসের সঙ্গে উড়ে চিমনিতে ঢোকার চেষ্টা করছে। ভুরু কুঁচকাল কিশোর। গরম আবহাওয়া। এই সময়ে ফায়ারপ্লেস, জ্বালানোর দরকার পড়ল কেন?
দৌড়ে গেল সে। ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা চিমটাটা তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল আগুনের ভেতর। কিন্তু কাগজ, যা ফেলা হয়েছিল পুড়ে গেছে। চিমটার খোঁচা। লেগে ঝুরঝুর করে ভেঙে গেল পোড়া কাগজ।
কি করছ? কিশোরের হাত থেকে চিমটাটা টান মেরে নিয়ে নিল এলেনা। রাগত কণ্ঠে বলল, এখানে ঢুকেছ কেন? যাও, নিচে যাও!
মিস লিসটার, বেশ গঙার ভারিক্কি গলায় বলল কিশোর, আমরা থাকলে আপনার সুবিধে হতে পারে। রহস্যময়, অস্বাভাবিক ঘটনা, এসব তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি।