লম্বা দম নিল মুসা। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। দেয়াল, ময়লা পর্দা আর রঙচটা কার্পেট থেকেই হালকা কুয়াশার মত উড়ছে ওই ধুলো-তার ধারণা।
বড় একটা ড্রেসারের ওপরে ঝুলছে একটা আয়না, দাগ পড়া, হলদেটে। পেছনে জায়গায় জায়গায় পারা উঠে গেছে। ড্রেসারের পাশে দুটো ছোট আর্মচেয়ার রাখা। গদির রঙ উঠে গেছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোরও একই রকম করুণ দশা। জাহাজ আর সাগরের ছবি–উত্তাল সাগরে চলেছে জাহাজ, ঢেউ আছড়ে ভাঙছে পাথুরে উপকূলে।
আর সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে যেন বুককে। দেয়াল ঘেঁয়ে, ড্রেসারের ধারে, চেয়ারের পাশে। বই উপচে পড়ছে ওসব কেসে। পেপারব্যাক, হার্ডকভার, ছোট বই, বড় বই, ভলিউম; খাড়া করে, কাত করে, শুইয়ে, যতোভাবে ঢোকানো সম্ভব, রাখা হয়েছে। আর আছে কাগজপত্র। রোল পাকিয়ে, চ্যাপ্টা করে, ভাজ করে, গুঁজে দেয়া হয়েছে বইয়ের ফাঁকে সামান্যতম জায়গা যেখানে পাওয়া গেছে। সেখানেই। আরও আছে বাদামী রঙের ম্যানিলা খাম আর ফোল্ডার, ছোট, বড়, বইয়ের মাথার ওপরের ফাঁকে, কিংবা পাশের অন্যান্য ফাঁকে। মা বিছানার দিকে তাকাল আবার মুসা। লিসটার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেমন খসখসে কাঁপা নিঃশ্বাস পড়ছে। তবে নিয়মিত। হাড্ডিসর্বস্ব আঙুলগুলো এখন আর মুঠো হয়ে নেই, খুলে রয়েছে বুকের ওপর।
উঠে একটা বুককেসের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। বইয়ের পেছনের নাম পড়ল। একটার নাম ব্লাডি মার্ডার। আরেকটার নাম শার্ক হান্টার। এডগার অ্যালান পো-র গল্প সংকলন রয়েছে কিছু। আরেকটা বইয়ের নাম দেখা গেল পোলারিস। ওটা টেনে বের করে খুলল সে। নাবিকদের গাইডবুক ওটা। সমুদ্রে নক্ষত্র দেখে কি করে জাহাজ চালাতে হয় তার ওপর লেখা।
গুঙিয়ে উঠলেন লিসটার। এমন চমকে উঠল মুসা যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বইটা আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল। তাকিয়ে রয়েছে বুড়ো মানুষটার দিকে। কানে আসছে নিচতলায় মেহমানদের কণ্ঠস্বর। কতক্ষণ চলবে পার্টি? কতক্ষণ তাকে আটকে থাকতে হবে এখানে, এমন একটা বিরক্তিকর কাজে?
হাতের দিকে তাকাল সে। ধুলো-ময়লা লেগে গেছে। বুককেসটা কতদিন পরিষ্কার করা হয় না কে জানে। কয়েক মাস হতে পারে, কয়েক বছর হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল মুসা। ওখানেও বই আছে। পুরনো আমলের বাথটাব আর ওয়াশবেসিনের পাশে একটা টেবিলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। নানা রকম গল্প আর প্রবন্ধের বইয়ের মাঝে রয়েছে কার্টুনের বই। অ্যাটমিক এনার্জির ওপর লেখা বইও আছে একটা। তার মানে যা পান তা-ই। পড়েন লিসটার, সব ধরনের বই। কিশোরকে বলার মত একটা খবর বটে।
কলের মুখ খুলে হাত ধুতে শুরু করল মুসা।
হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পেল তালা লাগানোর শব্দ।
এইই! টান দিয়ে তোয়ালে নিয়ে দরজার দিকে ছুটল সে। নব ধরে মোচড় দিল। নড়লও না। তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বাথরুমে।
নরম গলায় ডাকল সে, মিস্টার লিস্টার! মিস্টার লিসটার, দরজাটা খুলুন, প্লীজ!
কেউ জবাব দিল না।
আরও জোরে ডাক দিল, মিস্টার লিস্টার!
দরজার কাছ থেকে সরে গেল পদশব্দ। কাঠের পালায় কান রাখল মুসা। নিচতলা থেকে মেহমানদের কথা আর হাসি কানে আসছে। বাজনা বন্ধ। কাছেই
একটা দরজা খোলা হল। জোরাল হল নিচের কোলাহল।
মিস্টার লিস্টার!
কেউ সাড়া দিল না। দরজা খুলতে এল না কেউ।
অস্বস্তি লাগছে মুসার। ভয় লাগছে। বাথরুম ব্যবহার করায় কি রেগে গেলেন লিসটার? হয়ত ভেবেছেন মুসা চোরটোর কিছু। পুলিশকে খবর দিতে গেছেন?
বাথটাবের কিনারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল সে। পুলিশ এলে বরং ভালোই। আবার শোনা গেল পদশব্দ। একই রকম পায়ের আওয়াজ, আগের বার যেমন শুনেছিল। বাথরুমের দরজার কাছে এসে থামল। কিন্তু দরজা খুলল না।
বিচিত্র একটা শব্দ হল। মাটিতে পড়ে গেলেন বোধহয় লিসটার, কারও সঙ্গে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। গুঙিয়ে উঠল কেউ, তারপর চুপ।
লাফ দিয়ে উঠে দরজার কাছে চলে এল মুসা। থাবা দিতে দিতে চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার লিসটার!
কে এই সময় নিচে লিভিং রুমে আবার শুরু হল গানবাজনা। কোরাস গেয়ে উঠল রক দল, বেইবে, হোয়াই এইনটু ইউ মাই বেইবে নো মোর? জোরাল কণ্ঠ। সেই সাথে দ্রিম দ্রিম করে বাজছে ড্রাম।
মিস্টার লিসটার! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল মুসা, আপনি ঠিক আছেন?
বেজেই চলেছে বাজনা, গাইছে গায়কদের দল।
ঘামছে মুসা। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। লাথি মারতে শুরু করল দরজায়।
জবাব দিচ্ছেন না কেন লিসটার? হার্ট অ্যাটাক হয়েছে? হয়ত মারা যাচ্ছেন এ মুহর্তে, এ দরজাটার ঠিক ওপাশেই।
এই কে আছ, শুনছো? চিৎকার করতে লাগল মুসা। বের কর! বের কর আমাকে।
কেউ শুনল না তার ডাক। কেউ এল না।
বেইবে, হোয়াই এইনট ইউ মাই বেইবে না মোর? প্রশ্নটা করে উপসংহার। টানল গায়কেরা, কিন্তু বাজনা বন্ধ হল না। আরেক সুরে চলে গেল। ড্রামের বিরতি নেই। গেয়ে উঠল ওরা, রকিং রকিং রকিং অল দা নাইট।
হতাশ ভঙ্গিতে দুম দুম করে দরজায় কিল মারতে লাগল মুসা। এখন কি করব? ভাবছে সে। একজন মানুষ ওদিকে মরতে বসেছে। সে জানতে পারছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। করবটা কি এখন? কিশোরটা কোথায়?
শান্ত হয়ে বস, স্মৃতিতে বেজে উঠল যেন কিশোরের কণ্ঠ। মাথা ঠাণ্ডা রেখে। ভাব।