হাঁপ ছেড়ে বাচল যেন তিন গোয়েন্দা। যাক, অন্তত এই একটা দিন সাইমনের বাড়িতে এসে তার ভিয়েতনামী বাবুর্চি কিমের অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। অ্যাক্রন কিংবা ড্যানডেলিয়ন চেখে দেখার কোন ইচ্ছেই ওদের নেই।
পথ দেখিয়ে মেহমানদেরকে মস্ত ঘরটায় নিয়ে এলেন সাইমন, যেটা থেকে সাগরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। সরাইখানা চালু থাকার সময় এ ঘরটা ছিল প্রধান ডাইনিং রুম। এখন হয়েছে একাধারে লিভিং রুম, লাইব্রেরি আর অফিস। কফি টেবিল ঘিরে বসল সবাই। কেসের রিপোর্ট ফাইলটা ঠেলে দিল রবিন। এতে সব নেই, বলল সে। সেগুলো ডক্টর মনটাগো মুখেই বলবেন।
মাথা ঝাঁকালেন ডক্টর। আগে ফাইলটা পড়া শেষ করুন। আমার কাহিনী অনেক পুরনো একটা রহস্য নিয়ে। চারশো বছর আগের। তাড়াহুড়া নেই। সব বলা যাবে।
পড়তে আরম্ভ করলেন সাইমন। রান্নাঘরে শোনা যাচ্ছে বাচ্চাদের কলরব। কিন্তু পড়তে পড়তে এতই মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি, সে সব শব্দ কানেই ঢুকল না। শেষ পৃষ্ঠাটাও শেষ করে মুখ তুললেন। হাসলেন। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি খেয়েও তাহলে লিটারের মেজাজ ঠিক হয়নি! হাহ্ হাহ্।
কিশোরও হাসল। চিতাবাঘ কি আর চামড়ার ফোঁটা মুছে ফেলতে পারে। সিয়েটাও কিন্তু কম বদমেজাজী নয়। দুজনে মিলেছিল ভাল।
দুটো দক্ষিণ আমেরিকান দেশে সিয়েটাকে খুঁজছে পুলিশ, রবিন জানাল। বড় রকমের অপরাধী। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছে জেলখানায়। বিশপের ডায়রি চুরির ব্যাপারে তার হাত কতটা ছিল, ডক্টর মনটাগো সেটা ভাল বলতে পারবেন। এসব নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। আগেও অনেক অপরাধ। করেছে সিয়েটা। তবে বিশপের বই হাতে গিয়েই প্রথমবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। জেলে গেল। তার পরে কুকাজ করতে গিয়ে আরও কয়েকবার জেলে গেছে।
অ্যাটাচি কেস খুলে চামড়ায় বাধানো পুরনো বইটা বের করলেন মনটাগো। আইলিন লিসটারে ওটা খুঁজে পেয়েছিল কিশোর। আমি এখন শিওর, ডক্টর বলতে লাগলেন, এটাই বিশপ এনরিক জিমিনিজের হারানো ডায়রি। অনেক বছর আগে বোগোটাতে বাস করতেন তিনি। সোনার খনিতে ইনডিয়ান শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করার কারণে লোকে তার নাম দিয়েছিল রক্তাক্ত বিশপ। স্প্যানিশ বিজেতাদের দখল করা পান্নার খনিও দেখাশোনা করেছেন তিনি। স্প্যানিশ কলোনির একজন উঁচুদরের লোক ছিলেন। গভীর আঁতাত ছিল। সরকারের সঙ্গে।
লোকে বলে তিনিও অত্যাচারী ছিলেন। অথচ বিশপ তার ডায়রিতে লিখে গেছেন, খনির শ্রমিকদের ওপর স্প্যানিশদের অত্যাচারে তিনি মর্মাহত। সেসব অত্যাচার ঠেকানোর জন্যেই নাকি খনি পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন তিনি। একটা পান্নার খনিতেও গিয়েছিলেন। এক চিলতে জমিতে পাওয়া গিয়েছিল খনিটা। বেশি গভীরে খুঁড়তে পারেনি ইনডিয়ানরা, কেবল ওপরটা কিছুদূর খুঁড়েছিল। আরও ভেতরে কেন নামতে পারছে না ওর। সেজন্যে সাংঘাতিক অত্যাচার চলছিল। ওদের ওপর। দেখেশুনে আর স্থির থাকতে পারেননি বিশপ। ছুটে এসেছিলেন। বোগোটায়। স্প্যানিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে। যাতে ইণ্ডিয়ানদেরকে খনির কাজ থেকে রেহাই দেয়া হয়। সরকার কিছু করার আগেই পর্বতে ভূমিধস ঘটল। যে খনিটা দেখে এসেছিলেন বিশপ, সেটা চাপা পড়ে গেল। অনেক মাটির তলায়।
এ পর্যন্ত বলে থামলেন মনটাগো। দম নিলেন। তারপর ডায়রি খুলে পড়ে অনুবাদ করে বলতে লাগলেন, কয়েক মাস ধরে খুঁড়ল অনেক লোক মিলে। মাটি সরানোর চেষ্টা করল। কাজটা মারাত্মক বিপজ্জনক। আরও ভূমিধস নামতে পারে। আলগা মাটি খসে পড়ে মানুষকে চাপা দিতে পারে। কিন্তু এত বিপদের মধ্যেও লোকগুলোকে কাজ করতে বাধ্য করল সৈন্যরা। বিদ্রোহী হয়ে উঠল ইনডিয়ানরা। আর খুড়তে অস্বীকার করল। এই সময় আদেশ এল সরকারের কাছ থেকে, খনিটা বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ওটাতে আর কাজ করানোর দরকার নেই। বাঁচল ইনডিয়ানরা। তবে ঈশ্বরের অশ্রু খুঁজতে গিয়ে অনেক অশ্রু ঝরে গেছে ততদিনে।
হুমম! মাথা দোলালেন সাইমন। এতদিন তাহলে ভুল কথা জেনে এসেছি। বিশপ অন্যায় করেননি। অত্যাচারী ছিলেন না।
অযথা বদনামের ভাগী হয়েছেন, মুসা বলল। সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস…
বইয়ের মাঝখানে নাকি কিছু পৃষ্ঠা নেই। সাইমন জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলোতে কি লেখা ছিল? কিছু বুঝতে পেরেছেন?
ওগুলোই ছিল আসল, মনটাগো জানালেন। খনিটার অবস্থান। বোগোটা থেকে রওনা দিয়ে খনিতে পৌঁছতে যে কদিন লেগেছিল সে কদিনের কথা নিশ্চয়। লেখা ছিল ওই পৃষ্ঠাগুলোতে। ওই লেখার নির্দেশ পড়ে গিয়ে পৌঁছানো যাবে, সোগামোসোর সেই পান্নার খনিতে। যে জায়গায় বৃদ্ধা মহিলা তার ছায়া ফেলবে সেখানেই পাওয়া যাবে খনিটা। বৃদ্ধা মহিলা, অর্থাৎ ওল্ড উয়োমেন হল অ্যানডিজ পর্বতমালার একটা চুড়ার নাম। স্থানীয় ইনডিয়ানরা ওই নাম রেখেছে।
বহু বছর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল বিশপের ডায়রি। মালিক জানতই না এটাতে কি লেখা রয়েছে। তার হাত থেকে চলে গেল এক বই ব্যবসায়ীর হাতে, দুর্লভ বই কিনে বিক্রি করত ওই ব্যবসায়ী। তার মনে হয়েছিল মূল্যবান আবিষ্কার। করা যাবে ও বইয়ের লেখার মানে বের করতে পারলে। কিন্তু বের করার আগেই চুরি হয়ে গেল বইটা। পুলিশ সন্দেহ করল ব্যবসায়ীর অ্যাসিসটেন্টকে। লোকটার বাসায় গিয়ে হানা দিল একদিন। বেশ কিছু দুর্লভ দলিল বের করল ওখান থেকে। সব চোরাই মাল। দোকান থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে যেটার জন্যে যাওয়া সেই ডায়রিটাই পেল না।