বাবার পাশে পাশে এসেছে এলেনা। ওফ, আব্বা, একটি বারের জন্যেও কি চুপ থাকতে পার না! বাবার সঙ্গে সে-ও অ্যাম্বুলেন্সে উঠল। হাসপাতালে যাবে।
ঠিক ওই সময় আবার কেঁপে উঠল মাটি। মা-ভূমিকম্প ঘুরে যাওয়ার পরে হাজির হয়ে গেছে ছানা-ভূমিকম্প। ছোট ছোট কয়েকটা ঝাঁকুনি দিল। যেন হ্যাঁচকা টানে কাত করে ফেলল অবশিষ্ট দেয়ালটাকে, পুরোপুরি ধসিয়ে দিল ছাত, একটু আগেও যেটার নিচে আটকা পরে ছিলেন ডেভিড লিসটার। ধুলো উড়তে লাগল চারদিকে।
.
১৭.
তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা। স্যালভিজ ইয়ার্ডে আসবেন ডক্টর ত্রুগার মনটাগো। লিসটারকে উদ্ধার করে আনার পর পুরো একটা হপ্তা পেরিয়ে গেছে। তিনি এলে তাকে নিয়েই মিস্টার ভিকটর সাইমনের ওখানে যাবে ওরা। চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার নেই হলিউডে। জরুরী একটা কাজে ইউরোপ চলে গেছেন। তবে যাবার আগে দেখা হয়েছে গোয়েন্দাদের সঙ্গে। কেসের রিপোর্ট পড়েছেন। গল্পটা ভারি পছন্দ হয়েছে তাঁর। ছবি বানাবেন। চিত্রনাট্য লিখে দিতে অনুরোধ করেছেন মিস্টার সাইমনকে।
তাকে পুরো গল্পটা শোনাতেই তিন গোয়েন্দার যাওয়ার কথা আজ। রওনা হবে হবে করছে, এই সময় ফোন এসেছে রুক্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ডক্টর মনটাগোর। দেখা করতে আসতে চাইলেন তিনি। বিশপের বইটাতে কি লেখা আছে বলার জন্যে।
গাড়ি নিয়ে এলেন তিনি। কোথায় কি জন্যে যেতে হবে তিন গোয়েন্দাকে, খুলে বলল তাকে কিশোর।
আপনিও যেতে পারেন, মুসা বলল। অসুবিধে নেই। মিস্টার সাইমন খুব ভাল মানুষ। তাকে আপনারও ভাল লাগবে। অনেক বড় গোয়েন্দা। তেমনি বড় লেখক। কোনটাতে যে বেশি সুনাম কামিয়েছেন, বলা মুশকিল। বিরাট এক বাড়ির মালিক। এককালে ওটা সরাইখানা ছিল।
তাই নাকি? মনটাগো বললেন। শুনে তো যাওয়ার জন্যে লোভই হচ্ছে।
লোভটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়ার জন্যেই রবিন বলল, শুধু কি বাড়ি। ভিয়েতনামী একজন কাজের লোকও আছে। নাম নিসান, জাং কিম। সে-ও খুব ভাল। তবে একটা দোষ আছে, অদ্ভুত সব খাবার রান্না করার ঝোঁক। আর সুযোগ পেলেই মানুষকে খাইয়ে সেসব রান্না কেমন হয়েছে পরীক্ষা করার প্রবণতা। কিছু। কিছু রান্না তো দারুণ! আর কিছু কিছু…মুখেই দেয়া যায় না!
আর লোভ সামলাতে পারলেন না ডক্টর মনটাগো। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। বিশপের বই নিয়ে আলোচনা ওখানেও করা যাবে।
ডক্টরের গাড়িতেই চলল তিন গোয়েন্দা। সামনে বসল কিশোর, ড্রাইভারের পাশের সীটে। রবিন আর মুসা বসল পিছনে। পথ দেখিয়ে দিতে লাগল কিশোর। কোস্ট হাইওয়ে থেকে মোড় নিয়ে সরু একটা পাহাড়ী পথে উঠল গাড়ি। কিছু দূর এগোনোর পর বিরাট একটা শাদা রঙ করা বাড়ি চোখে পড়ল।
এই কিশোর, দেখ, পেছন থেকে বলল মুসা। বাড়ির দরজা খোলা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা মেয়ে। একটা চামড়ার ফিতে দিয়ে কপাল আর চুল বাঁধা। তাতে পাখির লাল পালক গোঁজা।
ইনডিয়ান মেয়ে! মনটাগো বললেন। ওর কথা তো কিছু বলনি।
নতুন এসেছে মনে হয়, জবাব দিল কিশোর। ইনডিয়ানদের মত লাগছে, তবে ইনডিয়ান নয়।
ভাল করে দেখে ডক্টরও একমত হলেন কিশোরের সঙ্গে। মেয়েটা এশিয়ান। লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে হাত নাড়ল। নিসান জাং কিম বেরিয়ে এল বারান্দায়। মেয়েটার হাত ধরল।
চুমাশ রাজকুমারীর পোশাক পরেছে। সুন্দর না? মেয়েটার কথা বলল কিম, ক্যালিফোর্নিয়ার আদিম মানুষের আচার আচরণ শিখছে।
মনটাগোকে নিয়ে বারান্দার দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। আরও কয়েকটা বাচ্চা বেরিয়ে এল। সবাই এশিয়ান। পরনে ইনডিয়ান পোশাক।
পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে বন্ধুত্বের চেষ্টা করছে এরা, বুঝিয়ে বলল কিম। আমেরিকানদের রীতিনীতি শেখাচ্ছে আমাদের দেশের বাচ্চাদের। যাতে সহজেই যে কোন আমেরিকান ইস্কুলে ভর্তি হতে পারে। সহপাঠীদের সাথে মিশতে পারে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পড়তে গেলে আর সে দেশের কিছুই জানা না থাকলে অসুবিধে হয়ে যায়।
প্রজেক্টটা তাহলে নতুন শুরু করলেন, হেসে বলল রবিন।
হ্যাঁ, করলাম।
ইনডিয়ানদের দিয়েই শুরু? আরও তো লোক রয়েছে আমেরিকায়।
তা আছে। তবে আসল অধিবাসী তো ইনডিয়ানরাই। এখানে তাদের রীতিনীতিই হল খাঁটি। বাকি সব ভেজাল। নানা দেশের লোক এসে ভিড় জমিয়েছে আমেরিকায়, সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। সে জন্যে ইনডিয়ানদেরই বেছে নিয়েছি। আজকে ওদেরকে রান্না শেখাচ্ছি। চুমাশ ইনডিয়ানদের রান্না। পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে শিখে এসেছি। অ্যাক্রন কেক। ক্রীমড ড্যানডেলিয়ন। আর হজমের সুবিধের জন্যে রোজহিপ চায়েরও ব্যবস্থা করব।
মারছে! বিড়বিড় করল মুসা, অবশ্যই নিচু স্বরে, যাতে কিম শুনে না ফেলে।
বেরিয়ে এলেন ভিকটর সাইমন। বাচ্চাদেরকে ভেতরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল কিম। ডক্টর মনটাগোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর। আসার উদ্দেশ্যও জানাল। বিশপের বই নিয়ে আলোচনা করতে চান ডক্টর। হাত মেলালেন সাইমন। খুব খুশি হলেন। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে ওয়েলকাম জানালেন ওদেরকেও।
প্রথমেই প্রশ্ন করল মুসা, আচ্ছা, স্যার, এই ক্রীমড ড্যানডেলিয়নের ব্যাপারটা কি বলুন তো?
মুচকি হাসলেন সাহিত্যিক গোয়েন্দা। ভয় নেই। কড়া নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি আমি। আমরা চুমাশ নই, ভিয়েতনামী শিশুও নই যে আমেরিকানদের রীতি শিখতে হবে। কাজেই পাহাড় থেকে শিখে আসা কোন ইনডিয়ান খাবার চলবে না। সকালে আমি নিজে বাজারে গিয়ে পছন্দ মত খাবার কিনে এনেছি। আলাপ আলোচনা শেষ হোক, তারপর খেতে বসব।