রাস্তার পাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে গেল কিশোর। কয়েক মিনিট। আগেও যেটা আস্ত ছিল, সেটার অনেকখানিই ধসে পড়েছে এখন। বাড়ি বলেই চেনা যায় না আর। তিন দিকের দেয়াল নেই। বাকি একটা দেয়ালের ওপর কাত হয়ে ঠেস দিয়ে রয়েছে কোনমতে ছাতটা।
ওটাই সেই বাড়ি! যেটাতে লিসটারকে বন্দি করে রেখেছিল পিকো!
সর্বনাশ! গুঙিয়ে উঠল রবিন। ভু-ভর্তা হয়ে গেছে…
থেমে গেল একটা গাড়ির আলো দেখে। উঁচুনিচু জমিতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে, এগিয়ে আসছে ওটা। অন্ধকারের চাদর ফুড়ে দিয়েছে যেন ওটার হেডলাইট। বিদ্ধ করেছে পিকোকে।
ধসে যাওয়া বাড়ির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সে। এগিয়ে আসা গাড়িটার দিকে তাকাল। অন্ধ করে দিয়েছে যেন তাকে হেডলাইট। পেছনে যে আরেকটা গাড়ি আসছে দেখতেই পেল না। হাতের ওপর জ্বলছে লাল-নীল আলো। পুলিশের গাড়ি।
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। এসে গেছে পুলিশ।
ফিরে তাকাল পিকো। ছেলেরা যে বাড়িটায় রয়েছে সেদিকে। হাতে এখনও রয়েছে বেজবল ব্যাটটা। বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সতর্ক রয়েছে। পিকো ব্যাট উঁচিয়ে তেড়ে এলেই সরে যাবে তিন দিকে। কিন্ত এল না লোকটা। বরং ব্যাটটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে হারিয়ে গেল ধসে পড়া বাড়ির দেয়ালের আড়ালে।
জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল পুলিশের গাড়ি। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে নামল দুজন অফিসার। ধসে পড়া বাড়িটার দিকে দৌড় দিল। আরনিও নামল। লিসটারের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে ছুটল, বলল, আর কোন ভয় নেই।
জবাবে ভেসে এল আরেকটা কণ্ঠ, রেডিওর স্পীকারের মত কড়কড় করে উঠল যেন, জলদি এস! গাধা কোথাকার! আস্ত একটা বাড়ি ধসে পড়েছে আমার ওপর, আর বলছে কোন ভয় নেই! রামছাগল!
ডেভিড লিসটার। বেঁচে আছেন এখনও। ধসে পড়া বাড়ির নিচে চাপা পড়েছেন। এত বড় বিপদে থেকেও মেজাজের সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি তার।
পিকোর পিছু নিয়েছে পুলিশ। রাস্তায় পৌঁছার আগেই ধরে ফেলল তাকে। হাতকড়া পরিয়ে দিল। নিয়ে আসতে লাগল গাড়ির দিকে।
ও-ই কিডন্যাপার, অফিসারদের দিকে এগিয়ে গেল রবিন।
পুলিশের হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পিকো। লাফ দিয়ে এসে লাথি মারার চেষ্টা করল রবিনকে। ঝট করে সরে গেল রবিন।
আবার তাকে চেপে ধরল পুলিশ। শক্ত করে, যাতে আর ছুটতে না পারে। টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে এনে তুলল।
দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আরনি। চিৎকার করে বলল, ভয় নেই, মিস্টার লিসটার, আমরা আপনাকে বের করে আনব।
তাহলে করছ না কেন? সারারাত লাগাবে নাকি? খেঁকিয়ে উঠলেন লিসটার।
এই সময় মনে পড়ল আরনির, সে কে, কেন এখানে এসেছে। বাবার কথা ভাবল। যাকে ধংস করে দিয়েছে দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে থাকা ওই বুড়োটা।
মিস্টার লিসটার, চুপ করে থাকুন! বলল সে। ফিরে গেল তার গাড়িতে। ভেতরে ঢুকে চুপ করে বসে রইল। আর কোন সাহায্য করতে রাজি নয়। বেরোলই না আর। মাঠের ওপর দিয়ে যখন নাচতে নাচতে ছুটে এল এলেনার গাড়িটা, তখনও না।
আসার সময় ফোন করে এসেছে নিশ্চয় এলেনাকে, অনুমান করল মুসা। আসতে এত দেরি হয়েছে সে জন্যেই। সব দিক গোছগাছ করেই এসেছে।
এলেনার সঙ্গে এসেছেন ওর মা। বাবা কোথায় আছে জানতে পেরে যেন পাগল হয়ে গেল মেয়েটা। দেয়ালের জানালা দিয়েই গিয়ে ঢুকতে চাইল। তাকে ধরে রাখলেন মা, যেতে দিলেন না।
আপনারা কিচ্ছু ভাববেন না, একজন অফিসার বলল। যা করার আমরা। করছি।
যা করার একটু জলদি করলে ভাল হয় না? চেঁচিয়ে বললেন লিসটার। ধুলোয় দম আটকে যাচ্ছে তো! লাশ হয়ে গেলে আর বের করে লাভ কি?
মড়মড় করে উঠল কাত হয়ে থাকা ছাত। গোঙাল। বাকি দেয়ালটাকেও ধসিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে।
জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ল দুই অফিসার। বাইরে যারা রইল, তারা দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। আপাতত পড়বে না আর দেয়ালটা, যতই হুমকি। দিক। ছাতটাও এমনভাবে আটকে গেছে পড়ার ভয় নেই। যদি আবার কাঁপুনি শুরু না হয়। বড় ভূমিকম্পের পরে মাঝে মাঝেই আবার শুরু হয় কাপুনি, বিরতি দিয়ে দিয়ে। সে রকম একটা কম্পন এলেই সর্বনাশ। এখন সামান্য একটা কাপুনিই। ছাতটাকে ধসিয়ে দিতে যথেষ্ট।
তবে আর কোন কম্পন শুরু হল না। খানিক পরে জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল। একজন অফিসার। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুচকাল। মেঝের সঙ্গে শেকলে বাধা। একথাটা জানানো হয়নি আমাদের। অনেকটা অভিযোগের সুরেই বলে গাড়িতে ফিরে গেল সে। সাহায্যের জন্যে ফোন করতে।
দমকলের গাড়ি এল ফোন পেয়ে। আধ ঘণ্টা পর। তবে এসে আর দেরি করল না একটা মুহূর্ত। আটকা পড়া মানুষকে উদ্ধার করার ট্রেনিং আছে ওদের। দুজন ঢুকে গেল জানালা দিয়ে। ভেতরের অবস্থাটা দেখে এল। একটা লোহাকাটার করাত চাইল সহকর্মীদের কাছে। করাত দিয়ে কাজ সারার পর চাইল একটা শাবল। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তাদের কাজ করার বিচিত্র শব্দ হতে লাগল। একটা স্ট্রেচার ঢোকান হল জানালা দিয়ে। এর খানিকক্ষণ পরে ওই পথেই বের করে আনা হল লিসটারকে।
ততক্ষণে একটা অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে।
খবরদার, মাথামোটার দল! অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় চিৎকার করে বললেন লিসটার, ছেড়ে দিও না!