ঢুকে পড়ল কিশোর আর মুসা। আগেই ঢুকে বসে আছে রবিন। হাত ধরাধরি করে এগোল তিনজনে, যাতে আলাদা হয়ে না যায়। অত অন্ধকার, চোখ খোলা। রাখা আর বন্ধ রাখা সমান কথা।
কয়েক পা এগিয়েই ফিরে তাকাল দরজার দিকে। বাইরের আলো আসছে, ফলে ওখানটায় অন্ধকার কিছুটা কম। ফ্যাকাশে। দরজার বাইরে থামতে শোনা গেল পিকোকে। খসখসে হয়ে উঠেছে নিঃশ্বাস। শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয় দরজার কাছে ঘাপটি মেরে রয়েছে, ভাবল কিশোর, ওদের বেরোনোর অপেক্ষায়। শব্দ শোনার চেষ্টা করছে, যাতে বুঝতে পারে ওরা কোথায় আছে।
অবশেষে নড়ল পিকো। একটা পা বাড়াল, নীরবতার মাঝে এত মদু শব্দও কিশোরের কান এড়াল না। পিছিয়ে যেতে লাগল সে। দরজার কাছ থেকে যতটা সম্ভব সরে যাওয়া উচিত।
এক পা এক পা করে পিছাতে পিছাতে দেয়ালে এসে ঠেকল, পিঠ। মুসা এসে থামল তার পাশে। নাকি রবিন? যে-ই হোক, তাতে কিছু এসে যায় না। তিনজনের একসঙ্গে থাকার দরকার,ব্যস।
পাশে সরতে শুরু করল তিনজনে। এক সময় পিঠের কাছটায় শুন্য মনে হল কিশোরের। দেয়াল নেই। ফাঁকা। তার মানে দরজা। যেটাতে রয়েছে ওরা তার পেছনে আরেকটা ঘর। দরজা দিয়ে পিছাতে লাগল কিশোর। সঙ্গে এল অন্য দুজন। আপাতত নিরাপদ। তবে কয়েকটা সেকেণ্ড কিংবা মিনিটের জন্যে। ওঘরেই রয়েছে পিকো। চুপ করে আছে। কান পেতে শুনছে নিশ্চয়। শব্দ শুনলেই ছুটে আসবে।
চারপাশে তাকাল কিশোর। আর কোন দরজা কিংবা জানালা আছে কিনা। বোঝার চেষ্টা করল। বেরিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। নেই। শুধু নিচ্ছিদ অন্ধকার। ঈশ্বরের অশ্রু
আরনি! এতক্ষণে মনে পড়ল তার কথা। আরনি কোথায়? পুলিশ নিয়ে আসছে না কেন?
মুসার সন্দেহই সত্যি হল, তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। মত বদল করেছে আরনি। ওদেরকে ফেলে চলে গেছে। যা করার এখন নিজেদেরকেই করতে হবে। কারও সাহায্য পাবে না। পিকোকে আক্রমণ করে তার হাত থেকে ব্যাটটা কেড়ে নিতে হবে। তার পরেও কথা থাকে। পিকোর পকেটে পিস্তল থাকতে পারে। ব্যাট হাতছাড়া হয়ে গেলে বের করবে ওটা। তাহলে মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে ওরা।
আচমকা কেঁপে উঠল মেঝেটা। ওদের পায়ের তলায় মাটির গভীরে যেন প্রচণ্ড তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারি কোন লরি রাস্তা দিয়ে গেলে যেমন কেঁপে ওঠে মাটি অনেকটা তেমনি।
তারপর গর্জে উঠল ধরণী। গর্জন বাড়ছেই, আরও, আরও। এমন ভাবে ভরে দিল দিগ্বিদিক, যেন ওই শব্দটাই একমাত্র আছে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। টলতে শুরু করল বাড়িটা। ঝিলিক দিয়ে উঠছে আলো। বিদ্যুৎ চমকের মত উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো। বাইরের টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলো চোখে পড়ল, মাটিতে দেবে যাচ্ছে, যেন মুহূর্তে নরম কাদা হয়ে গেছে কঠিন মাটি।
অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে যেন বাড়িটার। তীব্র আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। তীক্ষ্ণ রোম খাড়া করা শব্দ করে তা থেকে খুলে আসছে খুঁটিতেমারা পেরেক।
ভূমিকম্প! আর বুঝতে অসুবিধে হল না ছেলেদের। যে কোন মুহূর্তে এখন ধসে পড়তে পারে পুরনো বাড়িটা। দেয়াল থেকে সরে যাবে ছাত, ধুড়ুম করে ভেঙে পড়বে ওদের মাথায়। বাঁচতে চাইলে এখনি বেরিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু বেরোতে পারছে না কিশোর। এমনকি সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে। মেঝে দুলছে অশান্ত সাগরের মত। তক্তা আঁকড়ে ধরে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা চালাল।
আটকা পড়ল ও।
.
১৬.
কেঁপেই চলেছে ধরণী। থামবে না নাকি? বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে কিশোর। সিনেমায় দেখেছে, ভূমিকম্পের সময় কি রকম করে মাটি ফাঁক হয়ে যায়। তার ভেতরে তলিয়ে যায় ডাইনোসরের মত বিশাল প্রাণীও। কল্পনায় সেসব দেখতে দেখতে শিউরে উঠল সে। তার নিচেও ওরকম ফাঁক হয়ে যাবে না তো? তলিয়ে যাবে না তো মাটির গভীরে? তার পর হাজার বছর পরে ভবিষ্যতের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক খুড়ে বের করবে তার ফসিল হয়ে যাওয়া কঙ্কাল…
চারপাশে গুঙিয়ে চলেছে খুঁটি আর তজ্ঞা। দেয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে টানাটানি করছে ছাত। কাছেই বিকট একটা শব্দ হল। ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের বুক। এই বুঝি গেল বাড়িটা। না, পুরোটা নয়, একটা দেয়াল ধসে পড়েছে। আরও বিকট আরেকটা শব্দ হল। আস্ত একটা বাড়ি ধসেছে। এটাও পড়বে। হঁটকাঠের তলায় জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে তিন গোয়েন্দার।
অবশেষে দীর্ঘ এক যুগ পরে যেন থামল ধরণীর কম্পন। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। ঘরের কালো অন্ধকারের মাঝে চারকোণা একটা ফ্যাকাশে ফোকর চোখে পড়ল। জানালা। তারমানে দেয়ালটা দাঁড়িয়েই আছে। সাংঘাতিক শক্ত বাড়ি তো! ধসে পড়ার আর ভয় নেই।
অন্ধকারে বলে উঠল মুসা, বাপরে বাপ! কাণ্ডটা কি হল। এভাবে ভূমিকম্পের মধ্যে আর পড়িনি কখনও।
নাগরদোলায় চড়লাম! রসিকতার চেষ্টা করল রবিন, জমল না, কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল তার গলা দিয়ে।
পিকোর কথা মনে পড়ল কিশোরের। ভুমিকম্প শুরুর আগে পাশের ঘরটায় ছিল সে। এখনও কি আছে?
কাঁপা পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। ঘরটা এখন আর আগের মত অন্ধকার নয়। দেয়াল ধসেছে। রাস্তার গাড়ির আলো এসে পড়েছে ভেতরে। বাতাসে ধুলো উড়ছে। ভারি, কেমন যেন শ্যাওলা শ্যাওলা গন্ধ। পিকোকে দেখা গেল না।
অসংখ্য আলো আছে রাস্তায়। গাড়ির। তবে সব অচল হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে গেছে সব। লোকের চিৎকার, গাড়ির তীক্ষ্ণ হন, আগের নীরবতার কিছুই অবশিষ্ট নেই আর এখন। নড়ছে না একটা গাড়িও, কিংবা হয়ত নড়তে পারছে না।