এইই, শুনছো! আরও ঝুঁকে লিসটারের পা চেপে ধরল পিকো। জোরে ঝাঁকি। দিল। ঠিকই শুনতে পাচ্ছ। ভান করছ না শোনার। যেন বেহুশ হয়ে গেছে, এহ! আমার সঙ্গে ওসব চালাকি খাটবে না।
ঘাবড়ে গেল তিন গোয়েন্দা। লিসটারকে কিছু করবে না, তো পিকো? পুলিশ নিয়ে আরনি ফেরার আগেই ওরা কিছু করার চেষ্টা করবে?
বইটা চাই আমি! লিসটারের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল পিকো। ওটা আমার জিনিস, আমি অনেক কষ্ট করেছি, আদায় করে নিয়েছি বলা যায়। সারাটা জীবনই নষ্ট করেছি ওটার জন্যে। জেল খেটেছি। তোমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে আপত্তি ছিল না আমার। কিন্তু তুমি এমনই লোভী, পুরোটা একাই মেরে। দেয়ার তালে ছিলে। তুমি আমাকে জেলে পাঠিয়েছ, পাঠাওনি? বইটা হাতে পেতেই চলে গিয়েছ পুলিশের কাছে। গিয়ে বলেছ ওটা কার কাছে আছে জান। আমার নাম বলে দিয়েছ। আমাকে অ্যারেস্ট করল ওরা। আমার মত একজন মানুষকে! পিকো সিয়েটাকে! ছ্যাচড়া চোরের মত কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গিয়ে আমাকে জেলে ভরল পুলিশ!
আমার ঘরে বইটা পায়নি ওরা, তা-ও জান তুমি। জানবেই তো, তোমার কাছেই তো ছিল। ওরা আমাকে কি করেছে জান? পিটিয়েছে। বার বার জিজ্ঞেস করেছে, বইটা কি করেছি। বলতে পারলাম না। ওরা ধরে নিল আমি ওটা বিক্রি করে দিয়েছি। কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। জেলে ভরলই ওরা আমাকে।
তারপর তুমি কোথায় গিয়েছ লিসটার, আমি জানি। সোজা সেই জায়গাটায় চলে গিয়েছিলে। পকেট ভর্তি করার জন্যে। ধনী হওয়ার জন্যে!
বিছানার কাছ থেকে সরে এল পিকো। ঘুরে দাঁড়াল। পায়চারি শুরু করল। মুঠো শক্ত হয়ে গেছে।
আরনি যেদিকে গেছে অধৈর্য হয়ে সেদিকে তাকাল মুসা। এখনও আসছে না। কেন? এত দেরি কেন?
পায়চারি থামাল পিকো। বিছানার কাছে গিয়ে আবার কথা বলতে লাগল। অন্য রকম হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। মানসিক চাপের লক্ষণ। তার জন্যে এখন তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তুমি ভেবেছ, তোমার মেয়েটা গিয়ে পুলিশকে বলবে। ওরা খুজতেই থাকবে,খুজতেই থাকবে, তারপর নাটকীয় ভাবে চলে আসবে, এখানে, তোমাকে উদ্ধার করার জন্যে। না, তা হবে না। সে রকম কিছু যাতে না ঘটতে পারে সেজন্যে সতর্ক রয়েছি আমি। মেয়েটা আস্ত ভীতু। রাতে একা বাড়িতে থাকতে পারে না বলে কয়েকটা ছেলেকে ডেকে এনেছে সঙ্গ দেয়ার। জন্যে। আরও বেশি যখন ভয় পেলে, পালিয়ে চলে গেল মায়ের কাছে। ও রকম একটা মেয়ের ওপর ভরসা করে আছ তুমি। পুলিশ নিয়ে আসবে। হুহ! এখানেই। থাকতে হবে তোমাকে, বুঝলে?
কোথায় আনা হয়েছে ভাল করেই জান তুমি, লিসটার। এখানে কেউ আসে। কেউ চলাচল করে না এদিক দিয়ে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কারও কানে যাবে না। সময়ের অভাব নেই আমার। তাড়াহুড়া করব না। যতক্ষণ না বলছ, ছাড়ছি না। বুঝলে?
গটমট করে শাটারের কাছে এসে দাঁড়াল পিকো।
ঝট করে একপাশে সরে গেল মুসা।
আরেক পাশে সরল রবিন।
কিশোর পিছিয়ে গেল। লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সময় মত পারল না, দেরি করে ফেলল। শাটার খুলে দিল পিকো। আরেকটু হলেই বাড়ি লাগত কিশোরের মুখে।
চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। পুরো একটা সেকেণ্ড নড়তে পারল না। কিশোর, পা যেন অসাড় হয়ে গেছে। তারপর পাশ থেকে হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিল মুসা। ততক্ষণে গোলমাল যা হওয়ার হয়ে গেছে।
দৌড় দিল তিনজনে।
চেঁচিয়ে উঠল পিকো। দড়াম করে আবার বন্ধ হয়ে গেল শাটার। আরও জোরে শব্দ হল দরজার।
ওদের পেছনে ছুটে আসছে পিকো।
পেছনে তাকাল কিশোর। লোকটার হাতে অস্ত্র দেখতে পেল। পিস্তল নয়। লাঠি জাতীয় কিছু। অন্ধকারে ভাল দেখতে পেল না সে, আন্দাজ করল পুরনো বেজবল ব্যাট হবে। পিকোর মত লোকের হাতে ওই জিনিসই আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। ওই ব্যাটের কাছে কিশোর আর মুসার জুডো ক্যারাট খাটবে না। লোকটার গায়ে ষাড়ের শক্তি। বন বন করে ঘোরাতে ঘোরাতে যদি এগিয়ে আসে, কাছেও ঘেষতে পারবে না তিনজনের কেউ। পালানো ছাড়া গতি নেই।
ছুটছে তিন গোয়েন্দা। তেড়ে আসছে পিকো, চিৎকার করে গালাগাল করছে। স্প্যানিশ আর ইংরেজিতে। সব বুঝতে পারল না ওরা। এটুকু বোঝা গেল, ধরতে পারলে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। গালাগাল থামিয়ে দিল আরও জোরে দৌড়ানোর জন্যে।
তাড়া খাওয়া জানোয়ারের মত গুঙিয়ে উঠল মুসা। দুটো বাড়ির মাঝের অন্ধকারে ঢুকে পড়ল। তার পেছনে গেল রবিন। সব শেষে কিশোর। নিজেকে যেন ছুঁড়ে দিল অন্ধকার ছায়ায় মিশে যেতে চাইছে।
পিকো থামছে না। আসছেই। ছুটে আসছে ব্যাট উঁচ করে।
আর দৌড়ানোর কোন মানে হয় না। বুঝতে পারছে তিনজনেই। রুখে দাঁড়ানোই দরকার।
ঝুঁকিটা অনেক বেশি হয়ে যাবে, ভাবল মুসা। মাথায় এক বাড়ি পড়লে, দুফাঁক হয়ে যাবে খুলি। বাড়ি লাগার আগেই ব্যাট ধরে হ্যাঁচকা টানে যদি নিয়ে চলে আসা যায় তাহলে…তবে তার জন্যে সুযোগ দরকার।
অযথা ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। পিকো একা, ওরা তিনজন, সুযোগ আসবেই। রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল মুসা। কিশোর এগোল ওদের। পেছনে। আবার ফিরে তাকাল পেছনে, পিকো কতখানি এসেছে দেখার জন্যে।
অনেক কাছে চলে এসেছে।
মুসা এসে দাঁড়াল কিশোরের পাশে। রবিনকে সরিয়ে দিয়ে এসেছে। হাত তুলে দেখাল। অন্ধকারে আবছামত চোখে পড়ল কিশোরেরও, একটা দরজা। শূন্য বাড়িটাতে ঢুকে লুকিয়ে পড়া যায়।