লিসটারের চিৎকারে সব আলাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই। নীরবতার মাঝে প্রচণ্ড শব্দ হল বাসন ভাঙার। ঝনঝন করে।
হাঁ হয়ে গেলেন লিসটার।
আব্বা, তোমার জন্যেই এমন হল? চেঁচিয়ে উঠল এলেনা। তুমি…তুমি… আব্বা!
বুক চেপে ধরেছেন লিসটার। ভঁজ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু।
আমি আগেই বলেছি। এজন্যেই রাগতে মানা করেছি। আব্বা? আব্বা? কডি, জলদি এস! বেহুশ হয়ে যাচ্ছে!
বাবার কোমর জড়িয়ে ধরল এলেনা।
.
০২.
লিভিং রুম থেকে দৌড়ে এল কালোচুল এক তরুণ। সে আর বেসিন মিলে মেঝে থেকে তুলল লিসটারকে। ডাইনিং রুম থেকে একটা চেয়ার এনে পেতে দিল। এলেনা, তাতে বসান হল তার বাবাকে।
আব্ব, কতবার মানা করলাম তোমাকে! রাগে, দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলল। এলেনা। আমি জানতাম এরকম একটা কিছু করবে।
ডাক্তার কই? চেঁচিয়ে উঠল মোটা এক মহিলা। সব কিছু ঠিক করার দায়িত্ব যেন এখন তারই। এগিয়ে এসে লিসটারের নাড়ি দেখল। টেলিফোন কোথায়? ডাক্তারকে ফোন করছি।
না! চিৎকার করে বলল লিসটার। হুশ ফিরেছে। ডাক্তার লাগবে না! লাগবে
ঝুঁকে দাঁড়াল কালোচুল তরুণ। মিস্টার লিসটার, আমরা আপনাকে সাহায্য করতেই চাইছি…
আমি বলেছি ডাক্তার লাগবে না আমার! খেঁকিয়ে উঠলেন লিসটার। ইডিয়ট!
কিছুই মনে করল না তরুণ। যেন শুনতেই পায়নি। দেখেশুনে কিশোরের মনে হচ্ছে লিসটারের স্বভাবই হল মানুষকে অপমান করা। কিন্তু একজন মেহমান এই অপমান সইবে কেন?
এই সময় নিচু গলায় একজনকে বলতে শুনল, ছেলেটার নাম কডি হোয়েরটা। লিটারের পারসনাল সেক্রেটারি।
আজকাল চাকরি পাওয়াটা বোধহয় কঠিনই হয়ে উঠেছে, শুকনো মন্তব্য করল আরেকজন।
ওপরে! লিসটার বললেন, ওপরে নিয়ে চল আমাকে! কয়েক মিনিট শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাব।
মেহমানদের দিকে তাকাল কডি। মুসার ওপর চোখ পড়ল। অস্বাভাবিক খাটো ওয়েইটারের পোশাক পরে বুফে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এই, তাকে ডাকল সেক্রেটারি। এস তো। ধর।
টেবিলে ট্রে রেখে লিসটারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। সে আর কডি মিলে লিসটারকে ধরে তুলল। ধীরে ধীরে নিয়ে চলল সামনের হলের দিকে, সেখানে রয়েছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। আগে আগে চলল এলেনা। মেহমানরা সরে পথ করে দিতে লাগল ওদেরকে।
একেবারে হালকা শরীর লিসটারের। যেন কোন ওজনই নেই। সিঁড়ি বেয়ে তুলতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না। মুসা একাই পারত। বেডরুমে নিয়ে আসা হল তাকে। ঘরটা বাড়ির সামনের অংশে। জানালা দিয়ে পর্বত দেখা যায়।
আরাম করে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল লিসটারকে। লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে ঢুকল এলেনা, বাবাকে এক গেলাস পানি এনে দেয়ার জন্যে। পানি এনে দিলে ঠেলে সরিয়ে দিলেন লিসটার। বিছানায় ছলকে পড়ল পানি। চেঁচিয়ে উঠলেন, নিট্রো! আমার নিট্রো কোথায়?
এই যে, আছে, একটা ড্রয়ার খুলল এলেনা। একটা ওষুধের শিশি বের করল।
খোল! জলদি কর! চাবুকের মত শপাং করে উঠল যেন লিসটারের কণ্ঠ। হাঁ। করে দাঁড়িয়ে আছ কেন, বলদের মত!
আব্বা, নিট্রো নয়, একদিন বিষ খাওয়াবো তোমাকে আমি। স্ট্রিকনিন। বিশ্বাস কর। শিশি ঝাঁকি দিয়ে উপুড় করল এলেনা। বাবার মেলে দেয়া হাতে। ফেলে দিল কয়েকটা ট্যাবলেট।
তা আর করতে দিচ্ছি না, লিসটার বললেন। উইলে কি লিখেছি ভাল করেই জান। আমার অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে একটা কানাকডিও আর পাবে না তুমি।
জিভের নিচে ট্যাবলেট রেখে দিয়ে চিত হয়ে শুলেন তিনি।
বাবা-মেয়ের এই ধরনের আলোচনায় অস্বস্তি লাগছে মুসার। বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরতেই তার হাত চেপে ধরল এলেনা। তুমি থাক এখানে, আব্বার কাছে। আমি যাই। মেহমানদের দেখাশোনা করিগে। কডি, এস। আমি একা পারব না।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। এত বদমেজাজী অসুস্থ একজন বুড়ো মানুষের কাছে থাকার কোন ইচ্ছেই তার নেই। মিস লিটার, বলতে গেল সে। ওখানে আমার কাজ…
এটাও কাজ, বাবার মতই খেঁকিয়ে উঠল এলেনা। এখানে থাকতে বলা হয়েছে, থাক।
কিন্তু…কিন্তু যদি ওঁর…মানে হার্ট বন্ধ হয়ে যায়…।
হবে না। এটা হার্ট অ্যাটাক নয়, অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল এলেনা। একে বলে অ্যানজিনা। রক্তবাহী শিরা বিদ্রোহ করেছিল বলা যায়। তাতে হৃৎপিণ্ডে ঠিকমত অক্সিজেন পৌঁছতে পারেনি। বুক ব্যথা করছে সে কারণেই। ট্যাবলেট নিয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।
তোমার হলে বুঝতে! কটকট করে বললেন লিসটার, যার হয় সে-ই বোঝে। ভয়ের কিছু নেই তুমি জানলে কি করে?
জানার ব্যাপার, তাই জানলাম। গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এলেনা।
মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল হোয়েরটা, যেন তার জন্যে আফসোস হচ্ছে, তারপর বেরিয়ে গেল এলেনার পিছু পিছু।
নিথর হয়ে পড়ে আছেন লিস্টার। চোখ বোজা। বিছানার কাছে একটা আর্মচেয়ারে বসল মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বৃদ্ধ মানুষটার দিকে। মুখের চামড়া ধূসর রঙের, তার মাঝে শিরাগুলো জেগে রয়েছে বেগুনী জালের মত। উঁচু, পাতলা নাক। বসা গাল। হাতের দিকে দৃষ্টি সরে গেল তার। একেবারে যেন কঙ্কাল, এক ছটাক মাংস আছে কিনা সন্দেহ। আড়াআড়ি ফেলে রেখেছে বুকের ওপর। যেন। কবর দেয়ার জন্যে শোয়ানো হয়েছে মানুষটাকে।
ভয় ধরে গেল মুসার। দ্রুত সরিয়ে নিল চোখ। দেখতে লাগল ঘরে কি আছে। গত শীতের পর বোধহয় আর পরিস্কার করা হয়নি ফায়ারপ্লেসটা। পিতলের কালো হয়ে যাওয়া বেড়ার ওধারে উঁচু হয়ে আছে ছাই। কাছে একটা পিতলের ঝুড়িতে রাখা কিছু লাকডি। আর একগাদা হলদেটে খবরের কাগজ। ওগুলো দিয়ে আগুন ধরাতে সুবিধে। ফায়ারপ্লেসের ওপরের ম্যানটেলপিসে সাজানো একটা জাহাজের মডেল, আর চীনামাটির মোমদানিতে দুটো মোম। সব কিছুতে ধুলো জমে রয়েছে। পুরু হয়ে।