তার কাছে গেলেই ভাল হয়, কিশোর বলল। তবে বইটা নিতে হলে। এলেনার অনুমতি দরকার। আমাদেরকে বইটা খুঁজে দিতে অনুরোধ করেছে সে, যাতে ওটা দিয়ে তার বাবাকে উদ্ধার করে আনতে পারে কিডন্যাপারদের হাত থেকে। হয়ত বইটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তার। বাবাকে উদ্ধার করতে পারলেই খুশি।
তা বটে, একমত হল মুসা। কেসটা এমনই, মাঝে মাঝেই আমি, কিডন্যাপিঙের কথা ভুলে যাই। অথচ ওটাই আসল ব্যাপার।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। লিটারের কেবিনের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। গেটে এসে চাবির গোছা বুঝিয়ে দিল দারোয়ানকে। তারপর চলল একটা পে ফোন খুঁজে বের করতে। এলেনার মায়ের বাড়িতে ফোন করে এবার আর তাকে পেল না। জবাব দিল আনসারিং মেশিন। একটা মেসেজ রেখে দিয়ে, রকি বীচে লিসটারের বাড়িতে ফোন করল কিশোর।
ফোন ধরল মিসেস বেকার। বলল, ধর। আমি ডেকে আনছি ওকে।
এলেনা লাইনে এলে তাকে সব কথা খুলে বলল কিশোর। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত যেন স্তব্ধ হয়ে রইল সে, যেন খবরটা হজম করতে সময় লাগছে, তারপর বলল, থ্যাঙ্ক গুডনেস!
বইটা কেন এত জরুরী, কিশোর বলল, বের করতে চান? নাকি শুধু পেলেই খুশি, কিডন্যাপারদের দিয়ে দেবেন?
দ্বিধা করল এলেনা। সময় কম। আবার ফোন করেছিল লোকটা। তাকে বলেছি বইটা খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। আর মাত্র একদিন সময় দিয়েছে।
তার মানে আগামী কাল পর্যন্ত সময় পাচ্ছি, খুশি হয়ে উঠল কিশোর। ডক্টর সাইনাসের কথা বলল। তিনি হয়ত পড়ে দেবেন। আর তার সময় না থাকলে অন্য কারও কাছে পাঠাবেন। তো বইটা কি নিয়ে যাব?
নিতে পার। আরেক মুহূর্ত দ্বিধা করল এলেনা। সেটাই বোধহয় ভাল হবে। কি জিনিসের জন্যে আব্বাকে আটক করেছে ওরা জানার আগ্রহটা চেপে রাখতে। পারছি না। লেগে যাও কাজে। এছাড়া আর কিছু করারও নেই এখন আমাদের। বইটা যে পেয়েছি লোকটাকে জানানোর উপায় নেই। সে ইচ্ছে করে যখন ফোন। করবে তখন বলতে পারব। তার আগে সম্ভব না।
একটা সেকেণ্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল এলেনা, আর বাড়িতে এখন বইটা রাখতেই সাহস পাচ্ছি না আমি। যেটার জন্যে আব্বা কিডন্যাপড় হয়েছে সেটার জন্যে আমারও ক্ষতি করতে পারে অন্য কেউ, বলা যায় না। কাল রাতে কেউ ঢুকেছিল এ বাড়িতে। আমার ঘর, আলমারি, ড্রয়ার সব খুঁজেছে। মনে হচ্ছে চাবি আছে লোকটার কাছে। আব্বাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হয়ত তার কাছ থেকে আদায় করেছে। ইচ্ছে মত আসাযাওয়া করতে পারছে এখন লোকটা।
একজন চাবিওয়ালাকে ডাকন, পরামর্শ দিল কিশোর। তালাগুলো বদলে দিয়ে যাক। এভাবে চলতে পারে না। ঠিক আছে, আমরা প্রফেসর সাইনাসের। ওখানে যাচ্ছি। কিছু জানতে পারলে আপনাকে জানাব।
রুক্সটনে প্রফেসর সাইনাসকে ফোন করল কিশোর। ভাগ্য ভাল। গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে, তবু অফিসেই পাওয়া গেল প্রফেসরকে। নিয়মিত অফিসে আসেন। তিনি ছুটিতেও। ছেলেদের জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি হলেন।
তাড়াতাড়ি ইয়ার্ডে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। রাশেদ চাচাকে অনুরোধ করল। পিকআপটা দেয়ার জন্যে। তিনি তখন বেরোচ্ছিলেন, তিন গোয়েন্দাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে যেতে রাজি হলেন। সেখান থেকে কাজে চলে যাবেন। ফেরার পথে সুযোগ পেলে আবার তুলে নেবেন ওদেরকে। আপাতত এই ব্যবস্থাই মেনে নিতে হল কিশোরকে।
একজন বন্ধুর সঙ্গে অফিসে বসে রয়েছেন প্রফেসর সাইনাস। তার বন্ধুটি ভীষণ রোগা। চকচকে টাক। ইনি ডক্টর ক্রুগার মনটাগো, পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। আমাদের ডিপার্টমেন্ট অভ রোমান্স ল্যাঙ্গুয়েজের হেড। তোমাদের জন্যেই বসিয়ে রেখেছি। পুরনো স্প্যানিশ পাণ্ডুলিপির প্রতি তাঁর সাংঘাতিক আগ্রহ।
হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল কিশোরের। এরকম একজনকেই আশা করছিল মনে মনে। প্রফেসর সাইনাসের চেয়ে ডক্টর মনটাগোকে দিয়ে বেশি সাহায্য হবে, বুঝতে পারছে সে। বিশপের বইটা বের করে বাড়িয়ে দিল ভক্টরের দিকে।
বই খুলে প্রথম পৃষ্ঠাটার দিকে চেয়েই বলে উঠলেন তিনি, বাহ! পাতার পর। পাতা ওল্টাতে থাকলেন তিনি। হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মুখ। সাংঘাতিক জিনিস!
কি স্যার? জানতে চাইল কিশোর।
পয়লা জানুয়ারি, সান্তা ফে বোগোটায়, আবার প্রথম পৃষ্ঠায় ফিরে এলেন, মনটাগো। লেখক নিউ গ্রানাডার মানুষের জন্যে ঈশ্বরের কাছে দোয়া করছেন। বলছেন যেন তাদের চেষ্টা সফল হয়। তারপর রয়েছে একটা চিঠির কথা। প্রাসাদে অপেক্ষা করছিল হিজ মোস্ট গ্রেশাস ম্যাজেসটি কিং কার্লোসের চিঠিটা।
বই থেকে মুখ তুললেন ডক্টর। এ তো একটা গুপ্তধন পেয়ে গেছ। এই জার্নালের লেখক সম্ভবত বিশপ ছিলেন। একটা প্রাসাদের কথা লিখেছেন তিনি। আসলে বলতে চেয়েছেন প্যালেস। বিশপের বসত বাড়িকে প্যালেসই বলে। তার কাছে চিঠি লিখতেন রাজা। ওই বিশপ সাধারণ পাদ্রী হলে এভাবে তাঁর কাছে লেখার কথা নয় রাজার। সেটা অবশ্য জানা যাবে একটু পরেই। এসব পুরনো লেখা থেকে তথ্য খুঁজে বের করার কায়দা আছে। কাগজ, কালি এসব পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে ডায়রিটা এনরিক জিমিনির, রক্তাক্ত বিশপ বলা হত যাকে!
রক্তাক্ত বিশপ? প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর।
ঢোক গিলল মুসা। কিছু হয়েছিল নাকি তার?
আসলে, আমাদের সবারই কিছু না কিছু ঘটে, ডক্টর মনটাগো বললেন। জীবন হল একটা সাময়িক ব্যাপার। তাই মৃত্যু থেকে মুক্তি নেই কারও। রক্তাক্ত বিশপের ঠাণ্ডা লেগেছিল। তখনকার দিনে ঠাণ্ডা ছিল মারাত্মক অসুখ। সহজেই নিউমোনিয়ায় রূপ নিয়ে শেষ করে দিত মানুষকে। শোনা যায়, অসুস্থতার সময় তাকে এড়িয়ে চলেছিল তার একজন চাকর। ইচ্ছে করেই। যাতে তার মৃত্যটা তাড়াতাড়ি হয়। তবে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না একথা। সন্দেহটা গাঢ় হয় একটা ব্যাপার থেকে, বিশপের মৃত্যুর পর পরই পালিয়েছিল সেই চাকর। প্রতিদিন জার্নাল লিখতেন বিশপ জিমিনিজ, কিন্তু তাঁর সেই জার্নাল পাওয়া যায়নি।