লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। সাগর থেকে, আসছে তাজা বাতাস। মাথার ওপরে চক্কর দিচ্ছে গাল, কর্কশ চিৎকার করছে। বাতাসে শুকনো শ্যাওলা, ঝিনুক, মাছ আর জাহাজের রঙের মিশ্র গন্ধ। পানি থেকে মেরামতের জন্যে শুকনোয় তোলার পর খোলে লেগে থাকা শ্যাওলা। শুকিয়ে এক ধরনের শুঁটকি শুঁটকি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
অনেক জাহাজের পাশ কাটাল ছেলেরা। বেশির ভাগই সেইলবোট। কাঠ আর ফাঁইবারগ্লাসে তৈরি বোটগুলো লম্বায় চল্লিশ থেকে ষাট ফুট। আইলিন লিসটার জাহাজটাকে অনেকটা আলাদা লাগল ওগুলোর তুলনায়, অন্য রকম। ছোট একটা ওশন লাইনার। কালো খোল। শরীরটা শাদা। বিলাসতরীর রূপ দিয়েছে। ইয়টটাকে।
খাইছে! বলে উঠল, মুসা। বুড়োটার রুচি আছে! বাড়িঘরগুলো অমন করে রাখে কেন? এখানে তো কিপটেমি নেই!
থাকবে কি করে, রবিন মন্তব্য করল। এটা কাজের জিনিস যে। কমপিউটার রুমটা দেখনি। কেমন ঝকঝকে তকতকে, দামী মেশিন।
সেইলবোটগুলোকে যেভাবে পানি থেকে টেনে তোলা হয়েছে সেরকম করে তোলা হয়নি এটাকে। কংক্রিটের মস্ত ট্রেঞ্চের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে আনা হয়েছে, এটাকেই বলে ড্রাই ডক। ট্রেঞ্চের সাগরের দিকের বিশাল ওয়াটারপ্রুফ গেটগুলো বন্ধ, তালা দেয়া। জাহাজটাকে এখানে আনার পর দমকলের সাহায্যে সমস্ত পানি বের করে দেয়া হয়েছে। খটখটে শুকনো এখন খোলের নিচে। ড্রাই ডকের ভেতরে বিরাট বিরাট ইস্পাতের কাঠামোর ওপরে ডিমে তা দিতে বসা হাঁসের মত করে। যেন বসে রয়েছে আইলিন লিসটার।
সিঁড়ি উঠে গেছে জাহাজের ওপর। প্রথম ডেকে উঠল কিশোর। তারপর রবিন। আর মুসা।
সামনের দিকে এগোল তিনজনে। ব্রিজে ওঠার মই বেয়ে উঠে এল। চাবি বের করল কিশোর। এক এক করে তালায় ঢোকাতে শুরু করল। লেগে গেল একটা। হুইলহাউসের দরজা খুলল সে। ভেতরে ঢুকল ওরা। চারপাশে বড় বড় কাঁচের জানালা। বালি আর লবণ লেগে নোংরা হয়ে আছে। জানালার নিচে কেবিনেট, অনেক ড্রয়ার ওগুলোতে। অল্প আসবাবে সুন্দর করে সাজানো ঘরটা, জাহাজের হুইলহাউস যে রকম হয়।
আমি আশা করেছিলাম অগোছাল হবে, রবিন বলল। মিস্টার লিসটারের যা স্বভাব। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা সব।
জাহাজের ব্যাপারে হয়ত তার অন্য মনোভাব, কিশোর বলল। পুরনো জিনিস ছড়িয়ে রাখার জায়গা নয় জাহাজ।
কিংবা এমন কাউকে ক্যাপ্টেন বানিয়েছেন, মুসা বলল। যে নোংরামি একদম সইতে পারে না। তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না লিটার।
টান দিয়ে একটা ড্রয়ার খুলল কিশোর। সুন্দর করে একটার পর আরেকটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে ম্যাপ। দ্রুত ওগুলো উল্টে দেখতে শুরু করল সে। সবই নটিক্যাল চাট, কোথায় প্রবাল প্রাচীর, কোথায় গভীরতা কম, এসব দেখানো রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলের কাছের চার্ট ওগুলো।
সোগামোসোতে বন্দর নেই, রবিন বলল। ওখানে যেতে চাইলে স্থলপথে। যেতে হবে লিসটারকে। কিংবা ভেনিজুয়েলার কোন বন্দরে নেমে গাড়িতে করে।
আমরা এখানে সোগামোসো খুজুতে আসিনি, মনে করিয়ে দিল মুসা। এসেছি বিশপের বই খুজতে। সেটাই খোঁজা দরকার। কোথায় ওটা?
ভাল প্রশ্ন। একটা ড্রয়ার খুলল রবিন। আরেকটা। তারপর আরেকটা। ড্রয়ারের পর ড্রয়ার ঘেঁটে চলল, যা পেল, বেশির ভাগই চার্ট। আলমারিগুলোতে খুঁজছে মুসা। কিশোর খুঁজছে কয়েকটা খোলা তাকে। জাহাজ চালানোর ওপর কিছু বই পাওয়া গেল, আর কিছু যন্ত্রপাতি, কিন্তু বিশপের বইটা মিলল না। বিশপের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এরকম কিছুও না।
হুইলহাউসের প্রতিটি ইঞ্চি খোঁজার পর বেরিয়ে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল কিশোর। দুই সহকারীকে নিয়ে মই বেয়ে আবার নেমে এল ডেকে। দুই ধারেই সারি সারি কেবিন রয়েছে। ওগুলোতে ঢুকে দেখতে লাগল ওরা।
বেশির ভাগই মনে হল অব্যবহৃত। বাংক আর রেডগুলোতে চাদর বালিশ কিছুই নেই। উল্টে ফেলে রাখা হয়েছে ম্যাট্রেস। নাবিকদের কোয়ার্টারটা দেখে। মনে হল, অল্প কিছু দিন আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংকের নিচে একটা টি শার্ট দলা পাকিয়ে ফেলে রেখে গেছে একজন নাবিক। ময়লা ফেলার ঝুড়িতে পড়ে রয়েছে পোভা সিগারেটের গোড়া, দলা পাকানো কাগজ।
অবশেষে সবচেয়ে বড় একটা কেবিনে এসে ঢুকল গোয়েন্দারা। জানালায় পর্দা টানা। অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরটা। দরজার পাশের সুইচ টিপল কিশোর। আলো জ্বলল না।
পাওয়ার নেই, বিড়বিড় করে বলল সে। আইলিন লিসটার এখন মরা। জাহাজ।
দরজার পল্লা পুরোটা খুলে দিল কিশোর। চওড়া একটা বিছানা প্লাস্টিকের চাঁদরে ঢাকা। চেয়ার আর টেবিলগুলোও ঢেকে রাখা হয়েছে একই রকম চাদর দিয়ে। কেবিনের একধারে রয়েছে অসংখ্য তাক। তাকের সামনের ধারগুলোতে নিচু রেলিঙ দেয়া, যাতে কোন জিনিস গড়িয়ে পড়তে না পারে।
একটা তাকে টর্চ দেখতে পেল কিশোর। নামিয়ে এনে জ্বালল। সারা ঘরে আলো বোলাল।
হ্যাঁ, এটাই লিসটারের ঘর, মুসা বলল।
তাকের ওপর যা থাকার কথা তা-ই রয়েছে। বই আর বই। যেখানেই ফাঁক। পাওয়া গেছে ঠেসে ভরে দেয়া হয়েছে কাগজপত্র। বইয়ের ফাঁকে টোল পড়ে যাওয়া দুটো টেনিস বলও ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। চামড়ার একটা দস্তানা ফেলে। রাখা হয়েছে একটা বাউলিং ট্রফির পাশে, আরনেস্ট জে. ক্র্যাবস নামে একজনকে ওটা পুরস্কার দিয়েছে ওয়েস্টসাইড কোলারস ক্লাব।