কলাম্বিয়ার একটা শহর সোগামোসো।
দশ মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে লাইব্রেরি! ঘোষণা করল পাবলিক অ্যাড্রেস সিসটেমের যান্ত্রিক কণ্ঠ।
ইনডেক্স দেখে দ্রুত পাতা ওল্টাল রবিন। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম কোণের একটা ম্যাপ বেরিয়ে পড়ল। কলাম্বিয়া রয়েছে ওখানে। বেগুনী রঙে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। শাদাটে রঙে আঁকা রয়েছে অ্যানিডজ পর্বতমালা।
তেরছা দৃষ্টিতে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সোগামোসো! ইনডেক্সে বলা হয়েছে, শহরটার লোকসংখ্যা উনচল্লিশ হাজার। তার মানে বড় শহর নয়।
বোগোটার উত্তর-পুবে শাদা পর্বতের গায়ে ছোট্ট একটা ফোঁটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে সোগামোসো। এত দূরের একটা অঞ্চলে বৃদ্ধা মহিলাকে খুঁজতে কেন যেতে বলেছেন লিসটার? আসলেই কি তেমন কোন মহিলা আছে? বিশেষ কোন মহিলা? না যে কোন মহিলা হলেই চলবে?
ম্যাপের পাশে সোগামোসোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে।
কলাম্বিয়ায় বসতি তেমন জমে ওঠেনি, পড়ছে রবিন। মানুষজন বাস করে শুধু উপকূলের কাছে, আর অ্যানডিজ পর্বতমালার পশ্চিম দিকের পাদদেশে। উপকূলের কাছের ভেজা অঞ্চলে ইক্ষু আর ক্যাকাও-এর চাষ হয়। আর অনেক উঁচুতে, তিন থেকে সাড়ে ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সব চেয়ে বড় কফি খেত রয়েছে। উপত্যকায় জুনে বার্লি আর গম। পাহাড়ী চারণভূমিতে ভেড়া চরার ব্যবস্থা আছে, তাই বিপুল পরিমাণে ভেড়া পোষা হয় সেখানে। অ্যানটিওকুইয়া ভ্যালিতে রয়েছে টেক্সটাইল মিল। সোগামোসোর কাছে কয়লা আর লোহার খনি রয়েছে, তাই সেখানে গড়ে উঠেছে ইস্পাতের কারখানা। সোনা আর পান্নার খনিও রয়েছে পর্বতের গায়ে। বেশির ভাগ কলাম্বিয়ানই কফির আয় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।
মিটমিট করতে লাগল মাথার ওপরের আলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে। যাবে লাইব্রেরি, ঘোষণা করল লাউড স্পীকার।
ম্যাপটা ঠেলে সরিয়ে তাড়াহুড়া করে এনসাইক্লোপেডিয়ার তাকগুলোর কাছে, চলে এল রবিন। আমেরিকানায় বেশ কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা রয়েছে কলাম্বিয়া সম্পর্কে। ব্রিটানিকাতেও বেশ প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সব পড়ার সময় নেই। রেফারেন্স বই লাইব্রেরির বাইরে নিয়ে যাওয়ারও অনুমতি নেই।
আবার জ্বলতে লাগল আলো। তাকের কাছে দৌড়ে গেল রবিন। দক্ষিণ আমেরিকার ওপর লেখা দুটো বই বের করল। একটার নাম কলাম্বিয়া, ল্যাও অ্যাণ্ড কনট্রাস্টস। আরেকটা কলাম্বিয়া, ফ্রম নিউ এ্যানাডা টু বলিভার।
মেসেজটা টেবিল থেকে প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে চেকআউট ডেস্কে চলে এল সে। একটু পরেই বেরিয়ে এল বাইরে, লাইব্রেরির গেটের পাশের সাইকেল র্যাক থেকে সাইকেল বের করল। কলাম্বিয়ার ওপরে লেখা বইগুলো পড়তে পারলে খুশি হত। যতগুলো রয়েছে লাইব্রেরিতে। সময় পায়নি। যেদুটো নিয়েছে সেগুলো পড়ার জন্যেই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে সে। কোন সূত্র মিলতেও পারে, যা দিয়ে লিসটার রহস্যের সমাধান হবে।
.
প্রায় দশটা বাজে। পায়ের শব্দ শুনতে পেল মুসা। লিভিং রুমে রয়েছে সে আর এলেনা। রেস্টুরেন্ট থেকে ফ্রাইড চিকেন এনে খেয়েছে। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলে দিয়ে আরাম করে বসেছে। বেশি গরম হয়ে গেছে ঘর। তবে বেশ আলো হয়েছে। অন্ধকার ছায়াগুলোকে একেবারে ঘরের কোণে ঠেলে নিয়ে গেছে যেন আগুনের লালচে আভা।
তাস খেলছিল দুজনে। এলেনা জিতছিল। এই সময় থেমে যেতে হল পায়ের শব্দে। শুনেই বুঝল মুসা চিলেকোঠার দিকে যাচ্ছে কেউ। নীরব বাড়িটাতে সেই শব্দ বেশ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, যেন সমস্ত বাড়িতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
দমে গেল মুসা। ওপরতলায় যেতে চায় না সে। লিসটারের বাড়িটা ভাল, লাগেনি। কেমন যেন! ভূত থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখানকার সব কিছুই তার অপছন্দ। ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা। অনেক ধোয়ামোছা দরকার। দরজা জানালা সব খুলে দিয়ে বোদ বাতাস লাগানো দরকার। আর এমন একটা চিলেকোঠা রয়েছে যেটা কারও প্রয়োজনই নেই, কেউ ব্যবহার করে না। গত রাতেও নাকি পায়ের শব্দ পাওয়া গেছে, অথচ রবিন আর কিশোর গিয়ে কিছুই দেখেনি।
গত রাতে হয়েছিল, আজ আবার শুরু হয়েছে।
মুখ তুলল এলেনা। শুনছ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল সে।
না বলতে চাইল মুসা। কিছুই বলতে পারল না। আরেকদিকে মুখ ফেরাল।
পেছনের দরজায় তালা লাগিয়েছিলে? এলেনার প্রশ্ন।
আমি তো মনে করেছি আপনি লাগিয়েছেন।
উঠে দাঁড়াল এলেনা। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ ঢুকেছে।
ওপথে ঢুকলে শুনতে পেতাম। দরজা খুললেই টের পেয়ে যেতাম আমরা।
রান্নাঘরের দিকে এগোল মুসা। দরজাটা পরীক্ষা করল। তালা দেয়া। ছিটকানি লাগানো ওপথে। কেউ আসেনি।
নাকি কেউ ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দিয়েছে?
রান্নাঘরে এসে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল এলেনা। ভ্রুকুটি করল। তারপর পিছিয়ে: বেরিয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করে হলে চলে এল মুসা। সিঁড়ির দিকে চেয়ে রয়েছে এলেনা।
শুনছো! এলেনা বলল।
জোরালো হয়েছে পদশব্দ। চিলেকোঠার কাঠের মেঝেতে ফাপা আওয়াজ তুলছে।
মরুক! টেলিফোনের দিকে এগিয়ে এল এলেনা। রিসিভার তুলে ৯১১ ডায়াল করল। শয়তানটার কথা পুলিশকে না বলে আর পারছি না।
শয়তান, অর্থাৎ মানুষের কথা বলছে এলেনা। কিন্তু আসলে কি মানুষ? কিশোর বলেছে গতরাতে সিঁড়ি দিয়ে কাউকে উঠতে দেখেনি। কাউকে নামতেও দেখেনি। কিন্তু চিলেকোঠায় গিয়েছিল কেউ। হেঁটেছিল।