ডেভিড লিসটার রহস্যময় মানুষ। রকি বীচে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন। নিঃসঙ্গ মানুষ। একা থাকতে পছন্দ করেন। মকিংবার্ড লেনে তার বাড়িটা যেন একটা পোড়োবাড়ি। বাগানটাকে বলা যায় লতাপাতার জঙ্গল। আর কিছুদিন ওভাবে পড়ে থাকলে দক্ষিণ আমেরিকার ইতুরি জঙ্গল হয়ে যাবে। লোকে বলে, ঢুকলে গা ছমছম করে। ভূতের বাসা। মুসা যে রাজি হতে চায়নি আসতে এটা একটা কারণ।
লিসটারের মেয়ে এলিনার সম্মানে দেয়া হচ্ছে এই পার্টি। বৃদ্ধের একমাত্র মেয়ে সে। বোর্ডিঙে থেকে স্কুলে পড়ত। ফলে রকি বীচের ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি, বন্ধুত্ব করতে পারেনি। এখন পুবের একটা কলেজে পড়ে। গোপনে তিন গোয়েন্দাকে বলেছে বেসিন, মেয়েটা এই পার্টিতে তার এনগেজমেন্টের খবরও ঘোষণা করতে পারে। বেসিন নিশ্চিত, ভাবি জামাইকে দুচোখে দেখতে পারবেন না লিসটার। এই পার্টি দেয়ারও ইচ্ছে ছিল না তার, মেয়ের চাপে বাধ্য হয়েছেন।
সারাক্ষণ গজগজ করছে বুড়ো, বেসিন বলেছে। এসব নাকি টাকা পানিতে ফেলার ফন্দি। চাপে পড়ে রাজি হয়েছে বটে, তবে যতটা সম্ভব কম টাকা খরচ করে কোনমতে কাজটা সারতে চায়। কিছু সাধারণ খাবার আর কয়েকজন তৃতীয়। শ্রেণীর মিউজিশিয়ানকে ভাড়া করেছে, যেনতেন ভাবে মেয়েকে খুশি করতে পারলেই বাঁচে। তার ইচ্ছে, মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে, মেয়ের ফিয়াশেকে ভয় দেখিয়ে, দুজনকে আলাদা করবে। তারপর ওয়াল স্ট্রীটের কোন বড় ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে। মেয়েকে ব্যবসায় ঢোকাবে। এগুলো সবই অবশ্য আমার অনুমান।
সমস্ত কথা মনে পড়ছে কিশোরের। কলরব করছে মেহমানরা। কেন যে এত কথা বলে লোকে বুঝতে পারে না সে। অহেতুক বকবক করে। চীজ পাফ সরবরাহ করতে লাগল ওদেরকে। অবাক হয়ে ভাবছে কোন মানুষটা ডেভিড লিসটার। বেশির ভাগই মাঝবয়েসী। সে শুনেছে, লিসটারের বয়েস সত্তর। মেহমানদের পরনে দামী পোশাক। দামী দরজির দোকান ঘুরে এসেছে। অনেক খরচ পড়েছে তার জন্যে। এরকম দামী পোশাক লিসটারের পরনেও থাকবে, আশা করতে পারল না সে।
হাসাহাসি করছে মেয়েরা। উচ্চকণ্ঠে কথা বলছে। চেঁচাচ্ছে। গান গাইছে। যা ইচ্ছে করছে। ওদেরই কেউ একজন হবে এলেনা লিটার। হয়ত চুলের রঙ হবে লাল, পরনে শাদা পোশাক। কিংবা হতে পারে সোনালি চুল, তাতে গোলাপী আভা। ওই যে সোনালি চুল, নীল পোশাক পরা মেয়েটা কথা বলছে ধূসর সিল্ক পরা মহিলার সঙ্গে সে-ও হতে পারে এলেনা। কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। মহিলাকে। যখন পাশের মসৃণ চেহারার তরুণের সঙ্গে কথা বলার জন্যে ঘুরল মেয়েটা, ছাতের দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে রইলেন মহিলা। অমনোযোগী। হঠাৎ হাত উঠে গেল গলার কাছে। ঈশ্বরের অশ্রু
ওপরে তাকাল কিশোর। এক কোণে মাকড়সার জাল ঝুলে রয়েছে। কে। জানি একটা শুয়াপোকা মেরেছিল, দেয়ালে লেপ্টে রয়েছে এখনও।
বিরক্তিতে কুঁচকে গেল মহিলার মুখ, দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলেন। হাসি চাপতে কষ্ট হল কিশোরের। গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ওয়েইটারের কাজ, এখন তাই মনে হল। তবে আনন্দ পাচ্ছে।
হঠাৎ, মিউজিশিয়ানরা সবে একটা বাজনা শেষ করেছে, এই সময় একটা গেলাস ভাঙল একটা মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল কিশোর, ডেভিড লিসটার কার নাম। লম্বা, তালপাতার সেপাই, ধূসর চুল, কালো মলিন স্যুট পুরনো হতে হতে চকচকে ভাবটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এক কোণ থেকে ছুটে এলেন তিনি। রাগে চিৎকার করে ছুটলেন বাগানের দিকে। কিশোরের মনে হল, মেয়েটাকে ধরে মারবেনই বুঝি লিসটার। শেষ মুহূর্তে সামলে নিলেন। বকা দিলেন, গায়ে জোর নেই? খাও না? বিড়বিড় করে আরও কি বললেন, বোঝা গেল না। কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে।
আব্বা, রাগটা একটু কমাও, বলে লিসটারের দিকে এগিয়ে গেল নীল পোশাক পরা মেয়েটা।
এলেনা? মেয়েটাকে আটকানোর জন্যেই বোধহয় হাতটা বাড়িয়ে ছিলেন ধূসর চুল মহিলা, সরিয়ে নিলেন। মসৃণ চেহারার যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিক, দেখলি! একটা লোক বটে!
এগিয়ে গেল যুবক। এলেনা, দাঁড়াও। মিস্টার লিসটার, শান্ত হোন। মেয়েটা তো আর ইচ্ছে করে ফেলেনি। আপনি…
ফিরেও তাকালেন না লিসটার। গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুললেন ধাক্কা দিয়ে। দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন।
তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। সাংঘাতিক ব্যস্ত বেসিন। চুলার কাছ থেকে দৌড়ে যাচ্ছে টেবিলের কাছে, আবার টেবিল থেকে চুলার কাছে। অনেকগুলো প্লেটে খাবার সাজাতে হচ্ছে। একগাদা বাসন সিংকে ফেলে ধুচ্ছে ভবঘুরে লোকটা।
হেনরি, চিৎকার করে উঠলেন লিসটার। কোত্থেকে কি ধরে এনেছ! ওই গর্দভ মেয়েটাকে বের কর আমার বাড়ি থেকে! ওই গেলাসের দাম রেখে দেবে ওর কাছ থেকে! নইলে তোমার টাকা থেকে কাটব।
আব্বা, শান্ত হও না, আহ! পেছনে গিয়ে দাঁড়াল মেয়ে। এমন কাণ্ড শুরু করলে! আমার পার্টিই তো শেষ করবে। এসো। এই, আব্বা। প্লীজ! লিসটারের হাত ধরে টান দিল এলেনা। এ কিন্তু চিৎকার বন্ধ করার ইচ্ছে নেই লিসটারের। ফিরে তাকাল পিকো। হাতে একগাদা বাসন। তাকিয়ে রয়েছে ভদ্রলোকের চোখের দিকে। এতগুলো বাসন। একসঙ্গে নেয়াই বোধহয় ঠিক হয়নি, কিংবা অন্য কোন কারণে গেল একটা। পিছলে। ব্যস, বাকিগুলোও মেঝেতে পড়ে ভাঙল ওটার সঙ্গে সঙ্গে।