রবিনের পেছনে হলঘরে এসে ঢুকল এলেনা। পরনের শোবার পোশাকটা দুমড়ে কুঁচকে গেছে। ভারি হয়ে আছে চেহারা। কি ব্যাপার? কি হয়েছে? কিশোর, ওখানে কি করছো?
এলেনা, মেয়েটার অনুরোধেই তাকে মিস লিসটার বলা বাদ দিয়েছেনকিশোর। এ বাড়িতে কি কোন গোপন পথ আছে? চিলেকোঠায় ওঠা যায়?
জানি না তো?
কোন গুজব শুনেছেন পথটা সম্পর্কে।
মাথা নাড়ল এলেনা। না।
খুঁজতে লাগল কিশোর। বাক্স আর ট্রাঙ্কের পিছনে দেখল। চিমনির কাছের জিনিসপত্র সরাল, যদি কোন গুপ্তদরজা থেকে থাকে ওখানে সে আশায়। রান্নাঘর থেকে একটা টর্চ নিয়ে এল। কাঠের মেঝের শেষ প্রান্তে যেখানে চালু হয়ে। কডিকাঠের ওপর নেমে এসেছে ছাত; সেখানে খানিকটা খোলা জায়গা রয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে দেখতে দেখতে সেখানটায় চলে এল। শোবার ঘরের ছাতের কিছুটা জায়গার পাসটার চোখে পড়ে এখান থেকে। তবে বেরোনোর মত কোন পথ নেই। বহু বছরে অনেক ময়লা জমেছে ওখানে। আর এমন টুকিটাকি জিনিস, যেসব ফেলে দিয়ে তারপর ভুলে যায় লোকে। যেমন, একটা পুরনো, গলফ বল, একটা কোকা কোলার বোতল, আর দলা পাকিয়ে ফেলে দেয়া কিছু কাগজ।
চিলেকোঠার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখে তারপর বেরোল কিশোর। নেমে এল নিচের হলঘরে। রবিন আর এলেনা বসে রয়েছে ওখানে।
আশ্চর্য! পথ নেই শুনে বলল রবিন।
সব তোমাদের কল্পনা, বলল এলেনা।
নিজের ঘরে গিয়ে আবার দরজা দিল সে।
শোবার ঘর থেকে গিয়ে কম্বলটা নিয়ে এল রবিন। শরীর মুড়ে বসে পড়ল। কিশোরের আমচেয়ারের পাশে।
শোবে না আর? কিশোর বলল, এখন আমার ডিউটি। চলে যাও।
একা যেতে আর ভাল্লাগছে না। এখানেই থাকি।
বাকি রাতটা ওখানে বসেই কাটাল দুজনে। তাকিয়ে রইল সিঁড়িতে যাওয়ার। পথের দিকে। একটু পর পরই মুখ ভোলে ছাতের দিকে। কান সজাগ এমনি করেই ভোর হল।
আরেক বার পায়ের আওয়াজ শুনল বলে মনে হল রবিনের। তবে এত হালকা, নিশ্চিত হতে পারল না সত্যিই শুনেছে কিনা।
অবশেষে পাতলা ধূসর আলো দেখা দিল জানালায়। সূর্য উঠতে দেরি নেই। শেষ হল দীর্ঘ বিরক্তিকর পাহারার পালা।
হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল কিশোর। তালায় চাবি ঢোকানোর আওয়াজ শুনেছে। নিচতলায়। রান্নাঘরের দরজা খুলল। ওখানে কেউ রয়েছে। যার কাছে চাবি আছে।
একলাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল কিশোর। অস্ত্র। একটা অস্ত্র দরকার। খালি হাতে আর যাবে না।
কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রবিন।
ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে শব্দ করতে মানা করল কিশোর। চুপ থাকতে ইশারা করল। চিলেকোঠার সিঁড়ির দেয়ালে ঝোলানো একটা পিতলের বাসন দেখতে পেয়ে সেটাই খুলে নিল। ভাল কোন অস্ত্র নয়, তবে হাতে একেবারে কিছু না থাকার চেয়ে ভাল।
পেছনের সিঁড়ি ধরে ছুটে নামতে শুরু করল। পেছনে রবিন।
সিঁড়ির গোড়ায় নেমে রান্নাঘরের ভেতরে তাকানোর চেষ্টা করল। রান্নাঘরের। দরজার ওপরের অর্ধেকটা কাঁচের। কিন্তু অন্য পাশে কাপড়ের পর্দা লাগানো থাকায় এপাশ থেকে ভেতরটা দেখা যায় না। দরজা না খুলে ভেতরে কে আছে দেখার উপায় নেই।
সামনে এগোল কিশোর। বাসনটা শক্ত করে ধরল।
মৃদু একটা খটখট শব্দ হচ্ছিল। থেমে গেল সেটা। হাঁ হয়ে খুলে গেল দরজা।
বাড়ি মারার জন্যে বাসন তুলল কিশোর।
.
০৭.
ও বাবা গো!
চিৎকার করে পিছিয়ে গেল ধূসর চুল এক মহিলা। বাসনের বাড়ি থেকে বাঁচানোর জন্যে দুহাত তুলে নিয়ে এল মাথার ওপর।
পাথর হয়ে গেছে যেন কিশোর। একটা সেকেণ্ড জমেই রইল সে, বাসনটা তোেলা। মহিলার হাতের বাজারের থলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল এই মানুষের কাছ থেকে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সরি, বলে বাসনটা নামিয়ে নিল সে।
পুলিশ! আবার চিৎকার করে উঠল মহিলা। বাঁচাও! বলেই ঘুরে দিল দৌড়। গেটের দিকে।
আরে শুনুন শুনুন! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। প্লীজ! এক মিনিট।
শোবার পোশাক পরে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এল এলেনা। মহিলাকে দেখতে পেয়ে সে-ও চেঁচিয়ে ডাকল, মিসেস বেকার, শুনুন শুনুন!
কিশোরের পাশ দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। মহিলা অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই তাকে ধরে ফেলল। শুনুন। ওরা ভাল ছেলে। কিছু করবে না।
ধীরে ধীরে ফিরে এল আবার মহিলা।
রবিন, কিশোর, পরিচয় করিয়ে দিল এলেনা। ও মিসেস বেকার। আমাদের হাউসকীপার। মিসেস বেকার; ওরা আমার বডিগার্ড।
কড়া চোখে গোয়েন্দাদের দিকে তাকাতে লাগল মিসেস বেকার, বিশেষ করে কিশোরের দিকে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। কিশোরের মনে হল বহু বছর পর এত জোরে দৌড়েছে মহিলা।
বডিগার্ড? মহিলার চোখে সন্দেহ। গুপ্তধন পেয়েছ নাকি? বডিগার্ড লাগে কেন? তোমার আব্বই বা কোথায়? তোমার জন্যে তিনিই তো যথেষ্ট। যে কোন মানুষের জন্যেই! শয়তানও কাছে ঘেঁষবে না।
আব্বা নেই। নিরুদ্দেশ। কাল থেকে। কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে।
কিডন্যাপ? বল কি!
ঠিকই বলছি, এলেনা বলল। বাবার রহস্যময় নিরুদ্দেশের কথা খুলে বলল। র্যানসমের নোটটাও দেখাল মিসেস বেকারকে। এরা আমাকে সাহায্য করছে, গোয়েন্দাদের দেখিয়ে বলল সে। বিশপের বই খুঁজছি আমরা। ঈশ্বরই জানেন ওটা কি! ওই নামটা আব্বার মুখে কখনও শুনেছেন?
না, সোজাসাপ্টা জবাব দিল মিসেস বেকার। পাদ্রী-(বিশপ)র সঙ্গে তোমার আব্বার বনিবনা হবে না। কোনদিন হয়েছে বলেও মনে হয় না। তুমি বলতে চাইছ কেউ বাড়িতে ঢুকে, তোমার আব্বাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই নোট পাঠিয়েছে? ফ্যাকাসে ওই ছোকরাটাকে জামাই করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার, তুমি জান। আমারও পছন্দ নয় ছেলেটাকে। পছন্দ করার মত কিছু থাকলে তো করব। তোমার কাছে হেরে গিয়ে ওই পার্টি দেয়াটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে তোমার আব্বার। কিন্তু রাজি তুমি করিয়ে ছেড়েছ। আর দিয়েছ রোববারে, এমন একটা দিনে যেদিন আমার ডিউটি নেই। তোমার বাবা কিডন্যাপ হয়েছেন বলছ? আমার বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয় চলে গেছেন লুকিয়ে, নোট পাঠিয়েছেন তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে। আসলে কায়দা করে তোমার বিয়েটা ঠেকাতে চাইছেন।