আপনি পারেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।
শ্রাগ করল এলেনা। মনে হয়। অন্তত আর সবার চেয়ে বেশি। মজুতদারী ব্যবসা আরেকটু কম করলেই আমি খুশি হতাম। ওকাজটা আমার ভাল লাগে না। মাল কিনে জমিয়ে রেখে সুযোগ বুঝে ছেড়ে দেয়া। অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাকে আব্বা, তার মধ্যে ওটা একটা। এর জন্যে অবশ্য অনেক সচেতন থাকতে হয়। ভুল করলেই ডুবতে হবে।
আমার পাঁচ বছর বয়েসে আম্মার সঙ্গে আব্বার ডিভোর্স হয়ে যায়। কলেজে যাওয়ার আগে আম্মার কাছেই বেশি থাকতাম। অন্যখানে থাকলেও পরের দিকে প্রায়ই দেখা করতাম আব্বার সঙ্গে। তাকে মনে করিয়ে দিতে চাইতাম যে তার একটা মেয়ে আছে।
দোতলায় খোঁজা শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল। গুড নাইট জানিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল এলেনা। ওপর তলার হলঘরে পালা করে পাহারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর আর রবিন। এলেনার কাছাকাছি থাকতে পারবে এতে। সামনে আর পেছনের দিকটায়ও একই সঙ্গে নজর রাখতে পারবে। পা টিপে টিপে এসে হঠাৎ ওদের ওপর হামলা চালাতে পারবে না কেউ।
প্রথম পালা রবিনের। বেডরুম থেকে একটা আর্মচেয়ার এনে একটা কোকের বোতল হাতে নিয়ে আরাম করে বসল।
আলমারি থেকে কম্বল বের করে অব্যবহৃত শোবার ঘরের একটাতে শুয়ে. পড়ল কিশোর। শুরুতে মনে হল ঘুমই আসবে না। সারাদিন অনেক উত্তেজনা। গেছে। সেগুলো ঘুরছে মাথার মধ্যে।
রবিনের ঝাঁকানিতে ঘুম ভাঙল তার। তিনটে বাজে। আমি আর পারছি না। ওঠো। এবার তুমি যাও।
কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। সেই জায়গায় ঢুকল রবিন। হুমম! গরম কম্বলের জন্যে ধন্যবাদ।
দুঃখিত। তোমার ধন্যবাদটা নিতে পারলাম না, গোঁ গোঁ করে বলল কিশোর। হলঘরে চলে এল পাহারা দিতে। ঠাণ্ডা লাগছে। বসে পড়ল চেয়ারে। তার মনে হল, রাত তিনটে হল দিনের সব চেয়ে বিষণ্ণতম সময়।
ভোর হতে কতক্ষণ লাগবে জানা আছে, কিন্তু সেই সময়টা কাটবে কি করে। বুঝতে পারছে না।
মাথার ওপরে কি যেন নড়ছে। ওপর দিকে তাকাল। দম বন্ধ করে ফেলেছে। কান খাড়া।
কিছুই না! একেবারে নীরব। পুরনো অদ্ভুত এই বাড়িটা, স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলতে আরম্ভ করেছে। অলীক কল্পনা শুরু হয়ে গেছে তার।
কিন্তু না, কল্পনা নয়। আবার শোনা গেল। খুব হালকা নড়াচড়া। খালি পায়ে চিলেকোঠার মেঝেতে হাটছে যেন। ছোট্ট, হালকা পাতলা শরীরের কোন মানুষ।
কিন্তু ওখানে তো কারও থাকার কথা নয়!
উঠে দাঁড়াল কিশোর। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। চিলেকোঠার দরজার সামনে এসে থামল। হাত বাড়িয়ে নব চেপে ধরে মোচড় দিল। আস্তে ঠেলা দিয়ে ফাঁক করল পাল্লা।
অন্ধকার ঘর। আলোর চিহ্নমাত্র নেই। পরিত্যক্ত জায়গার এক ধরনের পুরনো ধুলোটে গন্ধ এসে নাকে লাগছে।
কেউ আছে। সিঁড়ির মাথায়। দেখতে পাচ্ছে না, তবে কাপড়ের মোলায়েম খসখস কানে আসছে। বুঝতে পারছে তাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে মানুষটা, ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে।
তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। মস্ত ভুল করেছে আসার আগে সিঁড়ির আলোটা না জ্বেলে। লোকটার হাতে পিস্তল থাকলে চমৎকার একটা নিশানা হয়ে আছে এখন সে।
যে লোকটা তখন আক্রমণ করেছিল এ কি সেই লোক? যদি হয়, ফিরে এল কেন? ভেতরেই বা ঢুকল কিভাবে? চিলেকোঠায় কি করছে?
পিছিয়ে এসে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর।
কি হয়েছে? কিশোরের পেছনে ফিসফিস করে কথা শোনা গেল।
এমন চমকে উঠল কিশোর যেন গুলি খেয়েছে।
আরে আমি।
এলোমেলো হয়ে আছে রবিনের পোশাক। পায়ে জুতো নেই। বিছানা থেকে সোজা উঠে চলে এসেছে। ছাতের দিকে দেখিয়ে বলল, ওপরে কেউ হাঁটছিল। ফিসফিস করছে এখনও।
তুমিও শুনেছো?
মচ করে উঠল একটা তক্তা। সিঁড়ি থেকে সরে গেছে লোকটা। বাড়ির সামনের দিকে চলেছে।
তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, কিশোর বলল। ওই লোকটা তোমার সামনে দিয়েই গিয়েছিল। আর কোন পথ ছিল না। ঘুমিয়ে ছিলে বলেই দেখতে পাওনি।
একটুও না? জোর দিয়ে বলল রবিন। এক সেকেণ্ডের জন্যেও না। ঘুম তাড়ানোর জন্যে দুবার উঠে পায়চারিও করেছি।
ভুরু কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। যাই হোক, সে ঢুকেছে। জানে সে একা নয়। আমরা রয়েছি। জানে ওখানে কি আছে। আর সেজন্যেই…
এক টান দিয়ে চিলেকোঠার দরজা খুলে ফেলল সে। চেঁচিয়ে বলল, এই, কে কে ওখানে?
জবাব নেই। তবে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।
আবার ডাকল কিশোর।
সাড়া নেই এবারেও।
চিলেকোঠার আলো জ্বালল কিশোর।
না না যেও না! বাধা দিল রবিন। লোকটার কাছে পিস্তল থাকতে পারে!
গুলি করার ইচ্ছে থাকলে এতক্ষণে করে ফেলত। তবে আত্মবিশ্বাসের জোর ততটা নেই।
এক দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। কেউ নেই। শূন্য ঘর। বুককেস, ট্রাঙ্ক আর বাক্সগুলো রয়েছে আগের মতই। কিন্তু কোন মানুষ নেই। চিলেকোঠা থেকে লোকটা সিঁড়িঘরে বেরোনোর আগেই সে উঠে যেতে চায়।
নিরাপদেই পৌঁছল। কিন্তু মানুষ দেখতে পেল না। শূন্য চিলে কোঠা। বুককেস, ট্রাঙ্ক, বাক্স সব আগের মতই রয়েছে। মানুষ নেই।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল সে।
কোন শব্দ নেই।
বেরিয়ে এল আবার সিঁড়িতে। নিচে তাকাল। ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
কিছুই নেই, কিশোর জানাল। আমরা…আমরা নিশ্চয় কোন ধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্যে ছিলাম!
আমি বিশ্বাস করি না!
কেউ নেই এখানে। চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। তবে এই সিঁড়ি বাদে আসাযাওয়ার আর কোন পথ যদি থাকে, আলাদা কথা। হ্যাঁ, তা-ই হয়েছে। পুরনো বাড়ি একটা। গোপন পথ থাকতেই পারে। আগের দিনে লোকে গুপ্তপথ তৈরি করে রাখত। এই পথের খবর যে ওখানে উঠেছে সে ছাড়া আর কেউ জানে না।