খচখচ করছে মন। চাচী এতক্ষণ কি করছেন? এই সময়ে তো তিনি অফিস ফেলে সাধারণত রান্না করতে যান না। আর গেলেও বড় জোর দুই কি তিন মিনিট। তাড়াহুড়া করে ফিরে আসেন। চুলায় চাপিয়ে দিয়েই। তারপর মাঝে মাঝে উঠে যান কতটা কি হল দেখার জন্যে। সাংঘাতিক একটা ব্যস্ত আর উত্তেজনাময় সময় কাটে তখন তার। নাহ, দেখতে হচ্ছে।
রোভার?
জঞ্জালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রোভার। ঘামছে।
আমি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি, কিশোর বলল। কাজ আছে। গেট দেখবেন।
আচ্ছা।
রান্নাঘরের খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল কিলোর।
ভেতরে কেউ নেই। চুলায়ও কিছু চাপানো নেই। মেঝেতে পড়ে আছে একটা খাবারের টিন, কেউ ফেলেছে। ঢাকনাটা খুলে গড়িয়ে গিয়ে পড়ে আছে এককোণে।
হঠাৎ শীত করতে লাগল কিশোরের।
কান পেতে আছে। নীরব হয়ে আছে বাড়িটা। ডাকবে? মেরিচাচী কি আছে বাড়ির ভেতরে কোথাও? নাকি অন্য কেউ ঢুকে বসে আছে, যে চমকে দিয়েছে চাচীকে, হাত থেকে তখন টিনটা পড়ে গিয়েছিল তাঁর। কে চমকে দিয়েছিল? চাচীই বা এখন কোথায়?
ডাইনিং রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। উঁকি দিল ভেতরে। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা বাসন। সেগুলো মোছার কাপড়টাও মেঝেতে। আলমারির তাকের ড্রয়ারগুলো খোলা। নিচে পড়ে আছে আরও বাসন-পেয়ালা আর চামচ।
মুখ শুকিয়ে গেল কিশোরের। জোরে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল, তবে চাপা দিল ইচ্ছেটা। উচিত হবে না। যে ঢুকেছে সে এখনও বাড়িতেই থাকতে পারে। মেরিচাচীকে ভয় দেখিয়ে আটকে রেখেছে হয়ত। কিশোর উল্টোপাল্টা কিছু করলে এখন চাচীর বিপদ হতে পারে।
ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে এগোল কিশোর। লিভিং রুমেও একই অবস্থা। তাকের বই আর অন্যান্য জিনিস মেঝেতে ছড়ানো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে মেঝেতে ফেলে রেখেছে। লিভিং রুমের পরে হলঘরেরও একটা অংশ চোখে পড়ছে। একটা ওয়ারড্রোব খোলা। কাপড়-চোপড় আর জুতো বের করে ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
কিন্তু মেরিচাচী নেই। দেখা গেল না কোথাও।
রাশেদ পাশার ব্যক্তিগত ঘরটাকেও রেহাই দেয়া হয়নি। তার ডেকসেট আর টার্নটেবলটা নেই। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে স্পীকারগুলো। বেশি বড় বলেই বোধহয় অসুবিধে হবে মনে করে নেয়নি চোর। নাকি নেয়ার সময় পায়নি? কেউ এসে হাজির হয়েছিল?
হাজির! হ্যাঁ, এটাই হবে! মেরিচাচী এসেছিলেন কোন কারণে। চোরটা বাধা পেয়েছিল।
কেন এসেছিলেন চাচী, সেটাও বুঝতে পারল কিশোর। ক্যাশবাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মনে পড়ল, রান্নাঘর দিয়ে আসার সময় ছোট টেলিভিশন সেটটার পাশের কাউন্টারে সেটা দেখে এসেছে। নিশ্চয় চাচীই রেখেছেন ওখানে।
দ্রুত আবার রান্নাঘরে ফিরে এল কিশোর। এখনও রয়েছে বাক্সটা। ডালা খুলে দেখল, ভেতরে টাকাপয়সা ঠিকই আছে। অনেক টাকা। একশো ডলারের বেশি। সেগুলো নেয়নি চোর।
কেন? মেরিচাচীই বা কোথায়?
চাচী! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। গলা কাঁপছে।
জবাবে বিচিত্র একটা মিশ্র শব্দ কানে এল। চাপা চিৎকার। সেই সাথে কিল মারার আওয়াজ।
প্রায় উড়ে গেল যেন কিশোর। রান্নাঘরের লাগোয়া আরেকটা ছোট ঘর আছে! অনেকটা স্টোররুমের মত ব্যবহার করা হয় ওটাকে। ওয়াশিং মেশিন আর ড্রাইয়ার মেশিনাগুলো ওখানেই থাকে। এককোণ রয়েছে একটা আলমারি, তাতে ঝাড়, ব্রাশ আর ঘর পরিষ্কারের অন্যান্য জিনিস রাখা হয়। ওটার ভেতর থেকেই এসেছে শব্দটা।
বাইরে থেকে আটকে দেয়া হয়েছে আলমারির পাল্লা, ঝুল ঝাড়নের লম্বা ভাণ্ডা দিয়ে। একটা মাথা দরজার হাতলে ঠেকিয়ে আরেক মাথা আটকে দেয়া হয়েছে ওয়াশিং মেশিনের সঙ্গে। ফলে ভেতর থেকে যত ঠেলাঠেলিই করা হোক,
চাচী, চিৎকার করে বলল কিশোর। ভেতরে আছ তুমি? আমি কিশোর!
আলমারির ভেতর থেকে চাপা কথা শোনা গেল আবার।
হ্যাঁচকা টানে ডাণ্ডাটা সরিয়ে আনল কিশোর। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আলমারির দরজা।
সফট ড্রিংকসের বোতল খুললে যেমন ফস করে আচমকা বেরিয়ে আসে গ্যাস আর তরল পদার্থ, অনেকটা তেমনি ভাবে বিশাল শরীর নিয়ে ছিটকে বেরোলেন মেরিচাচী। তার সঙ্গে বেরোল প্রচুর ধুলো, ব্রাশ আর নানারকম টিন।
কিশোর! এলি শেষতক!
টকটকে লাল হয়ে গেছে তার মুখ। ঘাড়ের কাছে চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। মেঝেতে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন তিনি। চোখ জ্বলছে।
দাঁড়া, আগে ধরে নিই শয়তানটাকে! তারপর দেখাব মজা!
মনে মনে হাসল, কিশোর। এই মুহূর্তে লোকটা যদি মেরিচাচীর সামনে পড়ে তাহলে ওর জন্যে করুণাই হবে তার।
১১.
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এল। রান্নাঘরের চেয়ারে বসে কিশোরের বানিয়ে দেয়া কফিতে চুমুক দিচ্ছেন তখন মেরিচাচী।
কি হয়েছিল, সব বলতে পারবেন, এখন ম্যাম? অনুরোধ করল একজন অফিসার।
নিশ্চয় পারবেন তিনি। আর বললেনও বেশ উৎসাহের সঙ্গে। তবে তাতে রাগ আর ক্ষোভ প্রচুর পরিমাণে মিশিয়ে। রান্নাঘরে এসেছিলেন তিনি স্যুপ তৈরি করার। জন্যে। সবে একটা টিন পেড়েছেন তাক থেকে, এই সময় ডাইনিং রুমে নড়াচড়ার শব্দ শুনলেন। ভাবলেন কিশোর এসেছে। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন।
জবাব পেলেন না। মুহূর্ত পরেই পেছন থেকে কেউ জাপটে ধরল তাকে। নাকেমুখে চেপে ধরল নরম কোন জিনিস। হাত থেকে টিনটা খসে পড়ে গেল। তার। ঠেলতে ঠেলতে তাকে নিয়ে যাওয়া হল আলমারিটার কাছে। ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দেয়া হলো। এমন ভাবেই ঘটে গেল ঘটনাটা, লোকটাকে দেখতে পর্যন্ত পারেননি তিনি। সারাক্ষণই পেছনে ছিল লোকটা।