বাড়ির পাশ ঘুরে বেরিয়ে এল একটা ছেলে। হাতে ডিটারজেন্ট-পাউডারের বাক্স। ডিকসনদের ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, বেবি, লোক এসেছে।
সামনের চত্বরে ছোট ফোয়ারাটায় গিয়ে পুরো বাক্স ঢেলে দিল সে।
বেজে চলেছে বাজনা।
ফোয়ারায় সাবানের ফেনা তৈরি হচ্ছে। ফুলে উঠল। বাইরে উপচে পড়তে লাগল ফেনা, ঘাসের ওপর দিয়ে পানির সঙ্গে বইতে শুরু করল। বাতাস এসে ঝাপটা দিয়ে কিছু ফেনা উড়িয়ে নিল। দেখতে দেখতে সাদা ফেনায় ভরে গেল। কাছের পাতাবাহারের পাতা আর গাছের ডাল।
দারুণ! চিৎকার করে নিজের শিল্পকর্মের প্রশংসা করল ছেলেটা।
তিন গোয়েন্দার মনে হল, সব কটা বদ্ধ উন্মাদ।
দরজায় কিল মারতে শুরু করলেন ডিকসন। মারতেই থাকলেন, মারতেই থাকলেন।
অবশেষে খুলে গেল দরজা। মানুষের আকৃতির আজব একটা প্রাণী যেন বেরিয়ে এল। মেকাপ করে করে ফ্যাকাসে সাদা করে ফেলা হয়েছে চামড়া। কালো লিপস্টিক।
ডলি! চিৎকার করে বললেন মিসেস ডিকসন।
এটা কিসের সাজ? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ডিকসন। পেত্নীর?
দরজা বন্ধ করে দিতে গেল ডলি। ঝট করে একটা পা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আটকালেন তার বাবা।
ডলি! মা আমার! ককিয়ে উঠলেন মিসেস ডিকসন। মেয়েকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালেন তিনি।
থমকে গেছে ডলি। কেঁপে উঠল ঠোঁট। চোখের কোণে পানি টলমল করল। ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ল মায়ের বুকে। জাপটে ধরল। মেয়ের ভুরুতে লাগানো কালো মাসকারা দাগ করে দিল মায়ের সাদা ব্লাউজ, কিন্তু পাত্তাই দিলেন না তিনি।
দরজায় হেলান দিলেন ডিকসন। চুপ করে আছেন। মা মেয়ের মিলন নাটক চলছে, তা-ই দেখছেন নীরবে। মা কাঁদছে, মেয়েও কাঁদছে। মিনিটখানেক পরে ওদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন।.স্টেরিও সেটটা দেখতে পেলেন, যেটা থেকে বেরোচ্ছে বিকট শব্দ। বন্ধ করে দিলেন।
আচমকা এই নীরবতা যেন বড় বেশি কানে বাজল।
হৈ চৈ কমে গেল অতিথিদের। ওরা বুঝতে পেরেছে, বয়স্ক মানুষ ঢুকেছে। পিছলে সরে যেতে শুরু করল যেন সকলে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই মা-বাবার সঙ্গে একা হয়ে গেল ডলি। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে পিজার মোড়ক, আর খাবারের ভুক্তাবশেষ। নোংরা করে রেখেছে। তিন গোয়েন্দার মনে হল, এই নরকে ঢোকার চেয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসে থাকা অনেক ভাল।
পার্টির লোকজনকে ভোজবাজির মত মিলিয়ে যেতে দেখে কান্না থামাল ডলি। ক্ষোভ জমতে লাগল মনে। শেষে সেটা প্রকাশই করে ফেলল, দিলে তো সব নষ্ট করে। আমার সব কিছুই এরকম করে নষ্ট কর তোমরা! চিৎকার করে উঠল, আমার পাটি নষ্ট করেছ! তা-ও যদি আমার টাকায় হত, এক কথা ছিল। সব করছে রোজার, আমার সম্মানে। কত কষ্ট করে কন্ট্রাক্টটা…
কন্ট্রাক্ট? মা-ও চেঁচিয়ে উঠলেন। কিসের কন্ট্রাক্ট?
কিসের আর! ড্রাকুলার! কি যে একখান ছবি হবে!..আম্মা, দেখলে তো আমি ভাল আছি। খামোকাই আমার জন্যে চিন্তা কর। অনেক শিখছি আমি। কিছু পয়সাও জমিয়েছি। ছবিতেও কাজ পেয়েছি। সব চেয়ে ভাল চরিত্রটা। ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস সাজতে হবে আমাকে।
চোখের পানি মুছে গেছে। ঝকঝক করে জ্বলছে এখন। তাহলে বুঝতেই পারছ, অবশেষে কাজ একটা জোগাড় করেছি আমি।…ওই তো, রোজার। ইয়ান। রোজার। হাত নেড়ে ডেকে বলল, মিস্টার রোজার আসুন, এই যে আমার আব্বা আর আম্মা।…আম্মা, তুমি ভাবতেও পারবে না আমাকে কিভাবে নিয়েছেন মিস্টার রোজার। দেখেই বুঝে গেলেন, ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসের চরিত্রটা আমাকেই দেয়া উচিত। আমিই পারব।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল লোকটা। এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল ঠোঁটে। তাড়াতাড়ি বলল, গুড ইভনিং।
তাকিয়ে রয়েছেন মিসেস ডিকসন। গোঁ জাতীয় বিচিত্র একটা শব্দ বেরোল ডিকসনের কণ্ঠ থেকে।
রোজারের বয়েস তিরিশ হবে। মসৃণ চেহারা। তেমনি মসৃণ বালিরঙা চুল। কান ঢেকে আছে। পোশাক-আশাকও মসৃণ, একটা ভঁজ নেই কোথাও।
ডলির আম্মা! মিসেস ডিকসনের দিকে তাকিয়ে বলল রোজার। কণ্ঠস্বরও মসৃণ, পোশাক আর চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। মা-মেয়ের চেহারা একেবারে এক। না বললেও চিনতাম।
কতোটা সত্যি বলেছে লোকটা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তবু খুশি হলেন। মিসেস ডিকসন। আরও খুশি হলেন যখন তার একটা হাত হাতে তুলে নিল রোজার, যেন সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে, এমনি ভঙ্গিতে। আপনারা এসেছেন, কি যে খুশি হয়েছি আমি। মনে হচ্ছে, এতদিন কেন দেখা হয়নি। আমিও ভুল করেছি। বেটসির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট সই করার আগে আপনাদের অনুমতি নেয়া উচিত ছিল। তাতে দেরি হত অবশ্য। হলে হত।
বিড়বিড় করে কি যেন বললেন মিসেস।
এমন মুখভঙ্গি করলেন ডিকসন, যেন পচা ইঁদুরের গন্ধ পেয়েছেন। ড্রাকুলা, না? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা?
ওটারই সীকল। পরের ঘটনা নিয়ে কাহিনী। একজন অভিনেত্রী চাইছিলাম। আমরা, অপরিচিত নতুন একজন, যে মিনার চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। ব্রাম। স্টোকারের কাহিনী পড়ে আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, ড্রাকুলার চেহারা দেখার পর আর তার ভোঁতা স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হবে না। হতে পারে না। জোনাথন হারকারটা কোন কাজেরই না তো, তাই ভ্যাম্পায়ারই হয়ে যেতে চাইবে মিনা। ড্রাকুলার সঙ্গে প্রেম করতে চাইবে। আর তা-ই করাব আমরা আমাদের ছবিতে। উপায় একটা বের করে ফেলেছি মিনাকে ড্রাকুলার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়ার।